রংপুর এক্সপ্রেস: উত্তরাঞ্চলে নতুন বছর শুরুর আগেই কালবৈশাখী ঝড়, শিলাবৃষ্টি আর বজ্রপাতে লিচু, আমের মুকুলসহ বিভিন্ন ধরনের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে । বিভাগজুড়ে এই ঝড়ে নিহত হয়েছেন ৩ জন কৃষক, আহত হয়েছেন অন্তত শতাধিক মানুষ। আজ সকালে হঠাৎ শিলাবৃষ্টি সেই সঙ্গে বজ্রপাত শুরু হয়। পড়ুন বিস্তারিত খবর-
রংপুর:
কালবৈশাখী ঝড়ে রংপুর জেলায় বিভিন্ন ধরনের ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বজ্রপাতে রংপুরের বদরগঞ্জের শামিম মিয়া (৩৫) ও তারাগঞ্জ উপজেলার নয়া মিয়া (৪০) নিহত হয়েছেন। রংপুর আবহাওয়া অফিসের তথ্যমতে, দুপুর ১২টার দিকে প্রচণ্ড ঝড় শুরু হয়। রংপুর মহানগরী ছাড়াও গঙ্গাচড়া, পীরগঞ্জ, মিঠাপুকুর, তারাগঞ্জসহ সব উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় এই ঝড় আঘাত হানে। জানা গেছে, ঝড়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে পীরগঞ্জ ও মিঠাপুকুর উপজেলায়। জানা যায়, হঠাৎ ঝড়োবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। বাড়ি ঘর উপড়ে গেছে, নষ্ট হয়েছে গাছপালা। জমির ফসলও নষ্ট হয়েছে।
লালমনিরহাট:
লালমনিরহাটে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে শুরু হয়ে ১০ মিনিট স্থায়ী ভয়াবহ শিলাবৃষ্টি ও ঝড়ে বসত-বাড়িসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়-ক্ষতি হয়েছে। জেলার বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা যায়, শিলাবৃষ্টি কারণে ওই দুই উপজেলার হাজার হাজার বসত-বাড়ির ঘরের উপরের টিন ফুটা হয়ে গেছে। এছাড়া ভুট্টা ও ইরি-বোরোসহ বিভিন্ন ক্ষেতের ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। গ্রামের এক চাষী জানান, তার চারটি টিনের ঘরে একটি টিনও ভালো নেই। এছাড়া ১২ বিঘা জমির ভুট্টা ও ১৫ বিঘা জমির ইরি-বোরো ক্ষেতের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে।
কুড়িগ্রাম:
ঝড়ে কুড়িগ্রামে ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। গত ৪৫ বছরের মধ্যে এত জোরে ঝড় ও বৃষ্টি হয়নি বলে জানান নাগেশ্বরী উপজেলার কৃষক আ. কাদের । তিনি বলেন, এই ঝড়ে তার দুটি ঘর উড়ে গেছে, সুপারির গাছ ছাড়াও বিভিন্ন ধরনের গাছ উপড়ে নষ্ট হয়ে গেছে। নষ্ট হয়েছে শাক এবং ধানের। ওই গ্রামের আরও এক চাষী বলেন, ঝড়ের কারণে রাস্তার গাছ উপড়ে পড়ে রাস্তা বন্ধ হয়ে গেছে।
আজ উত্তরের জেলাগুলোতে শিলাবৃষ্টিতে ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে লিচু, আমসহ বিভিন্ন ফসলের। কেউ কেউ বলছেন যে, তার জীবনে কোনদিন এমন শিলাবৃষ্টি দেখেন নি। ছবিটি দিনাজপুর থেকে তোলা।
দিনাজপুর:
দিনাজপুরের চিরিরবন্দর ও পার্বতীপুর উপজেলায় দুপুর পৌনে ১২টায় হঠাৎ শিলাবৃষ্টিসহ ঝড়ো-হাওয়া বয়ে যাওয়ায় জনজীবন থমকে যায়। এতে গাছে গাছে সদ্য আসা আম ও লিচুর গুটিসহ বিভিন্ন ফসলের ক্ষতির আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। এছাড়া দিনাজপুরের পার্বতীপুর উপজেলায় শিলার আঘাতে সৈয়দ আলী (৫৫) নামে এক কৃষকের মৃত্যু এবং শতাধিক ব্যক্তি আহত হয়েছেন। এছাড়া লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে পুরো উপজেলা। নিহত সৈয়দ আলীর বাড়ি উপজেলার চন্ডিপুর ইউনিয়নের চৈতাপাড়া গ্রামে। জানা যায়, মাত্র ১০ মিনিটের শিলা বৃষ্টির তাণ্ডবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে উপজেলার হাজার হাজার বাড়ি-ঘর, শিক্ষা ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। পার্বতীপুর উপজেলা ত্রাণ কর্মকর্তা তাজুল ইসলাম শিলা বৃষ্টিতে একজনের মৃত্যুর খবর নিশ্চিত করেছেন।
নীলফামারী:
শিলাবৃষ্টিতে নীলফামারী জেলার জলঢাকা, ডোমার ও ডিমলাসহ প্রায় সব উপজেলাতেই ক্ষতি হয়েছে। শিলার আঘাতে টিনের চাল ফুটো হয়েছে অনেকের। এছাড়া ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। সকাল সাড়ে ১০টার দিকে হওয়া শিলাবৃষ্টির আঘাতে জেলার ডোমার ও ডিমলার ১২ ইউনিয়নের প্রায় ৩৫০ বসত ঘরের টিনের চাল ফুটো হয়ে গেছে। ডোমারের ক্ষতিগ্রস্ত ইউনিয়নগুলো হলো, কেতকিবাড়ী, গোমনাতী, ভোগডাবুড়ি, বামনিয়া ও পাঙ্গা মটুকপুর। ভারী শিলাবৃষ্টির কারণে ডোমার ও ডিমলা উপজেলায় ভুট্টা, মরিচ, পেঁয়াজ, বোরোর ক্ষেতসহ বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে বলে জানা গেছে।
পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁও:
পঞ্চগড় জেলার প্রতিটি উপজেলায় কমবেশি ঝড় ও শিলাবৃষ্টি হয়েছে। সবচেয়ে বেশি শিলাবৃষ্টি হয়েছে সদর উপজেলায়। এ উপজেলার হাড়িভাসা, হাফিজাবাদ, কামাত কাজলদিঘী ইউনিয়নের বিস্তীর্ণ এলাকার টমেটো ও তরমুজের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঝরে গেছে আম ও লিচু বাগানের গাছের মুকুল। এছাড়া গম ও ভুট্টা ক্ষেতেরও ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ঠাকুরগাঁওয়ে শিলা বৃষ্টি আর ঝড়ে পাকা গম ও আমের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। বিশেষ করে মাটির খড়ের তৈরি কাঁচা বাড়িঘরেরও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বেশি। সড়কে গাছপালা ভেঙে পড়ে ও বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়ায় জনজীবন ও যানবাহন চলাচলে বিঘ্ন ঘটেছে। রংপুর বিভাগীয় কমিশনার কাজী হাসান আহমেদ বলেন, ক্ষতির পরিমাণ জানতে সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। পরবর্তী সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।
গাইবান্ধা:
গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে দুপুরে প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড় ও শিলা বৃষ্টিতে হয়েছে। এ সময় বৃষ্টির সঙ্গে শিলের আঘাতে বিভিন্ন এলাকায় কয়েকজন আহত হয়েছেন। স্থানীয়রা জানান, দুপুর পৌনে একটার দিকে উত্তর দিক থেকে ধেয়ে আসা প্রচন্ড কালবৈশাখী ঝড়ে গোবিন্দগঞ্জসহ পাশ্ববর্তী এলাকায় শিলা বৃষ্টি হয়। এতে শিলের আঘাতে তারা আহত হন। এদের মধ্যে একজনকে আশঙ্কাজনক অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করানো হয়েছে। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক একেএম রুহুল আমিন জানান, প্রায় আধা ঘন্টা ব্যাপী প্রচন্ড শীলা বৃষ্টিতে আমের মুকুল ও উঠতি ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। ক্ষতির পরিমান নিরুপন করতে সংশ্লিষ্ট উপজেলা কৃষি বিভাগকে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে বলেও জানান তিনি।
পাবনা:
পাবনার চাটমোহর, সুজানগর ও বেড়া উপজেলায় ঝড় ও শিলাবৃষ্টিতে ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। এছাড়াও শিলার আঘাতে চাটমোহরে ৩০ জন আহত হয়েছেন। স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, শিলাবৃষ্টিতে চাটমোহর উপজেলা সদর, কুমাড়পাড়া, কাথুলি, মথুরাপুর, বালুচর, সুজানগর উপজেলার ভুরকুলিয়া, ভাটিকয়া, শাড়ির ভিটা, সৈয়দপুর, আহম্মেদপুর, বোয়ালিয়া ও রানিনগর, বেড়া উপজেলার আমিনপুর, কাশিনাথপুর এবং ফরিদপুর উপজেলার বেশ কিছু এলাকায় ধান ও পেঁয়াজসহ বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষতি হয়েছে। সুজানগর উপজেলার কৃষক শাজান মোল্লা বলেন, আমার ৪০ বছর জীবনে এই প্রথম এত পরিমাণ শিলাবৃষ্টি দেখলাম। আমার ধান ও পিঁয়াজের যে ক্ষতি হয়েছে তা পুষিয়ে নিতে পারবো না। আমাদের এই বিল ও নদী এলাকায় যে পরিমাণ পিঁয়াজ ও ধান হয় সেটা দিয়ে আমরা সারা বছর চলি। এখন কি করে চলবো বুঝতে পারছি না।