রংপুর এক্সপ্রেস ডেস্ক:
ঈদকে সামনে রেখে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে ব্যাপক চাহিদার কারণে কঠোর পরিশ্রম করে টুপি তৈরি করছেন রংপুরের টুপি শ্রমিকরা। টুপি শ্রমিকদের নিপুন হাতের কারুকার্য সম্বলিত টুপি এখন ওমান, সৌদি আরব, কাতার ও জাপানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে রফতানি হচ্ছে। আর এতে করে গ্রামের হতদরিদ্র প্রায় ২৫ হাজার নারীর কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে। গৃহস্থলির কাজের পাশাপাশি টুপি তৈরি থেকে আয় দিয়ে পরিবারগুলো দারিদ্র্য জয় করেছে।
রংপুরের পীরগাছা উপজেলার নব্দিগঞ্জ, ইটাকুমারীর হাসনা গ্রামের প্রায় কয়েক হাজার নারী এ কাজ করছেন। শুধু পীরগাছা উপজেলায় নয়, রংপুর সদর, কাউনিয়া, লালমনিরহাটের তিস্তার চর, কুড়িগ্রাম জেলার বিভিন্ন গ্রামের নারীরা টুপি বানিয়ে নিজেদের স্বাবলম্বী করেছেন। রংপুরের কাউনিয়া উপজেলার বালাপাড়া ইউনিয়নের খোপাতি গ্রামের হাফেজ আবদুল আউয়াল। তার টুপি ফ্যাক্টরির নাম দিয়েছেন ‘এমএইচ টুপি কারখানা’।
টুপি তৈরিতে আবদুল আউয়ালের সাফল্য সম্পর্কে জানা যায়, তিনি সিলেট টেক্সটাইল জামে মসজিদের ইমাম হিসেবে চাকরি করতেন। পরে বদলি হয়ে আসেন কুড়িগ্রাম টেক্সটাইল মিলে। এরপর সরকার ২০০২ সালে বাধ্যতামূলক অবসরের ঘোষণা দিলে তিনি অবসরে যান। এসময় তিনি অবসরে যাওয়ার কারণে সরকার থেকে সাড়ে ৩ লাখ টাকা পান। কিছুদিন বসে থেকে প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ করে ফেলেন। এরপর মনে মনে ভাবেন, যে টাকা রয়েছে, তা টাকা দিয়ে এমন কিছু করবেন যাতে নিজে এবং সমাজের অবহেলিত মানুষও উপকৃত হয়। এ সময় তিনি জানতে পারেন তাদেরই গ্রামের পাশে ফেনী ও নোয়াখালী থেকে এসে টুপি বানিয়ে নিয়ে যাচ্ছে অনেকে।
পরে ২০০৫ সালে তার পূর্বপরিচিত এক লোকের মাধ্যমে ফেনী চলে যান। সেখান গিয়ে তিনি ব্যবসায়ী আবুল খায়েরের কাছে প্রায় ২ মাস টুপি বানানোর প্রশিক্ষণ নেন। এরপর তার কাছ থেকে ৩০০ পিস টুপি বানানোর কাপড় ও অন্যান্য জিনিসপত্র নিয়ে আসেন বাড়িতে। নিজে এবং বাড়ির পাশের কয়েক নারীকে সঙ্গে নিয়ে সেগুলোর কাজ শেষ করে আবার তা ফেনিতে পাঠিয়ে দেন। কাজ দেখে মালিক আবুল খায়ের বেশ খুশি হন। এ জন্য প্রতিটি টুপি তৈরি বাবদ তাকে দেওয়া হয় ৫শ’ টাকা। যাবতীয় খরচ বাদ দিয়ে প্রতি টুপিতে তার লাভ হয় ৪০ থেকে ৫০ টাকা। এভাবে শুরু হয় তার ব্যবসা। অবসর থেকে পাওয়া ও জমি বন্ধকের প্রায় পাঁচ লাখ টাকা দিয়ে নিজেই কিনে ফেলেন মোটরচালিত ৫০টি সেলাই মেশিন। ওইসব মেশিন দিয়ে চলে টুপি সেলাই ও এম্ব্রয়ডারির কাজ। কাউনিয়ার বালাপাড়ায় একটি বাড়ি ভাড়া নিয়ে করেছেন অফিস ও কারখানা। আস্তে আস্তে তার ব্যবসা প্রসারিত হতে থাকে।
কাউনিয়া উপজেলার হরিশ্বর গ্রামের তহুরা বেগম। তার দুই ছেলে এক মেয়ে। স্বামী মারা গেছেন অনেক আগেই। সংসারে জমি-জিরাত বলতে শুধু চার শতক ভিটা। তহুরা বলেন, স্বামী মজুরি দিয়ে সংসার চালাত। তিনি মারা যাওয়ার পর খেয়ে না খেয়ে অনেক কষ্টে কেটেছে সংসার। এরপর হাফেজ আউয়ালের টুপি তৈরির কারখানায় দেড় মাস প্রশিক্ষণ নেন। শুরু করেন টুপি বানানোর কাজ।
তিনি বলেন, এখন আর না খেয়ে থাকতে হয় না, ভালোই চলছে সংসার। তিনি জানান, তার কাজ হচ্ছে টুপির চারদিকে মোটা সুতা ঢোকানো। যাকে আঞ্চলিকভাবে বলা হয় হাসু। এতে তিনি পান প্রতিটি টুপির জন্য ২০ টাকা। এতে তার মাসে আড়াই থেকে তিন হাজার টাকা আয় হয়।
শহীদবাগ ইউনিয়নের ছাত্রী সুরাইয়া বেগম বলেন, যখন আমি একাদশ শ্রেণিতে পড়ি। এক সময় টাকার অভাবে লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়। এখন আমি টুপি তৈরির কাজ করে আমার লেখাপড়ার খরচ চালাই। পাশাপাশি বাবা-মাকেও কিছু সংসার খরচ দিই।
কাউনিয়ার জয়ন্তী রাণী জানান, তার স্বামী একটি এনজিওতে কাজ করেন। বেতন খুব একটা বেশি পান না। তাই তিনি টুপিতে নকশার কাজ করেন। তিনি আরও জানান, মাসে তিনটির বেশি টুপিতে নকশা করা যায় না। তিনটি টুপি নকশা করে তার আয় হয় ১২শ’ টাকা, যা দিয়ে স্বামী আর এক মেয়েসহ ভালোভাবেই দিন কেটে যায়।
এমএইচ টুপি কারখানার সুপারভাইজার খোরশেদ আলম বলেন, আমরা গ্রামে গ্রামে ঘুরে মহিলাদের সুতাসহ টুপি দিয়ে আসি নকশা করার জন্য। নকশা হয়ে গেলে তা আবার ফেরত নিয়ে আসি টাকা দিয়ে। এতে আমরা পাই প্রতি টুপি বাবদ ২০ টাকা।
মাহমুদিয়া হস্তশিল্প টুপি (এমএইচ টুপি) কারখানার মালিক হাফেজ আবদুল আউয়ালের ছেলে মাহামুদুল হাসান জানান, তার বাবা ব্যবসার প্রয়োজনে বেশির ভাগ সময় ওমানে থাকেন। ওমানের ব্যবসায়ী সেলিম মিয়ার সঙ্গে তাদের কয়েক বছর আগে চুক্তি হয়েছে। তখন থেকে সরাসরি তারা নিজেরাই ওমানে টুপি রফতানি করছেন। তিনি জানান, এখন সপ্তাহে সাড়ে তিনশ’ থেকে চারশ’ টুপি তৈরি হচ্ছে।
টুপির উৎপাদন খরচ ও বিক্রি প্রসঙ্গে মাহামুদুল হাসান জানান, সুতা, কাপড়, পরিবহন খরচ, বিদ্যুৎ, মজুরিসহ অন্যান্য খরচ মিলে একটি টুপিতে খরচ পড়ছে ৫শ’ থেকে ৫১৫ টাকা। ওমান পৌঁছানো পর্যন্ত খরচ পড়ে ৬শ’ টাকা থেকে ৬১৫ টাকা। ওই টুপি তিনি বিক্রি করেন ৬৫০ থেকে ৬৭০ টাকা। এতে সব খরচ বাদ দিয়ে প্রতি টুপিতে ৫০ থেকে ৭০ টাকা লাভ থাকছে।
তিনি বলেন, এনজিও থেকে কিছু টাকা ঋণ নিয়ে ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছি। যার ওপর অনেক সুদ দিতে হয়। কম সুদে টাকা পাওয়া গেলে ব্যবসা আরও বাড়ানো যেত। আয়ও বেশি করা যেত। মাসে ১৫শ’ থেকে ১৬শ’ টুপি রফতানি করা হচ্ছে। এ থেকে মাসে আয় হচ্ছে প্রায় ৯০ থেকে ৯৫ হাজার টাকা। তবে সব মাসেই আয় এক রকম থাকে না।
তিনি বলেন, এই টুপিতে উন্নতমানের কাপড়ের ওপর বাহারি সুতার কাজ করা হয়। ফলে কারুকার্য বেশি হওয়ায় টুপির দাম একটু বেশি পড়ছে। এ টুপি আমাদের দেশে বিক্রি হয় না। বিদেশি ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতেই রফতানিযোগ্য করে এসব টুপি তৈরি করা হয়।