গুলশানের হোলি আর্টিসান জঙ্গি হামলার দুই বছর ২২ দিনের দীর্ঘ তদন্ত শেষে গত সোমবার দায়ের করা ওই কেসের অভিযোগপত্র (Charge sheet) কোর্টে জমা দিয়েছে ইনভেসটিগেশন টিম। কেসটি ইনভেসটিগেশন করে পুলিশের Counter Terrorism and Trans-National Crimes (সিটিটিসি) ইউনিট। অভিযোগপত্রে জীবিত ৮ জঙ্গির বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র (Charge sheet) দেওয়া হয়েছে। অভিযোগপত্রে অন্য অভিযুক্ত ১৩ জঙ্গি ২০১৬ সালের ০১ জুলাই থেকে পরবর্তী সময় পর্যন্ত আইনশৃংখলা বাহিনীর জঙ্গিবিরোধী অভিযানে নিহত হয়। জঙ্গি হামলার অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়েছে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক শিক্ষক রেজাউল হাসনাত করিমকে। একই ঘটনায় আটক কানাডার টরেন্টো ইউনিভার্সিটির ছাত্র তাহমিদ হাসিব খানকে এক বছর আগে অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়।
অভিযোগপত্রে যাদের নাম এসেছে তাদের মধ্যে ৬ জন পুলিশ হেফাজতে ও দুই জঙ্গি পলাতক আছে। পলাতক দুই জন ভারতে লুকিয়ে আছে বলে গোয়েন্দাদের ধারণা। অভিযানে নিহত হোলি আর্টিসানের পাচক সাইফুল ইসলামকে শুরুতে সন্দেহের তালিকায় রাখা হলেও তার সম্পৃক্ততার কোনো প্রমাণ তদন্তকারীরা পাননি। এমনকি জঙ্গি হামলার পর আটক হোলি আর্টিসানের কর্মী জাকির হোসেন শাওনের কোনো সম্পৃক্ততা পাওয়া যায়নি।
অভিযোগপত্র প্রদানের দিন প্রেস ব্রিফিংয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও সিটিটিসির প্রধান মনিরুল ইসলাম জানান, এ হামলাটি চালানোর পেছনে জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল আন্তর্জাতিক জঙ্গিগোষ্ঠী তালেবান, আল কায়েদা, আইএস’র দৃষ্টি আকর্ষণ করা। জঙ্গিরা মনে করতো, ওসব জঙ্গি সংগঠনের অনেক অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র আছে। তাই তাদের দৃষ্টিতে আসতে পারলে এসব অস্ত্রশস্ত্র এবং প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সাহায্য পাওয়া যাবে। সিসিটিসির প্রধান আরও জানান, জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল সরকারকে বেকায়দায় ফেলার। তারা মনে করেছিল, এতে বিদেশি বিনিয়োগকারীরা এদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিবে, সরকার পড়বে বিপদে।
ঢাকায় হামলা চালানোর পেছনে জঙ্গিদের উদ্দেশ্য ছিল ইন্টারন্যাশনাল সন্ত্রাসী গোষ্ঠীগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ। জঙ্গিরা মনে করতো, তাদের দৃষ্টিতে আসতে পারলে তারা অত্যাধুনিক অস্ত্রশস্ত্র ও প্রযুক্তিগত সাহায্য পাবে। এছাড়াও জঙ্গিরা আক্রমণ করে বিভিন্নভাবে সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে চাইছিলো।
২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে হোলি আর্টিসান বেকারিতে থাকা বিদেশিসহ সব অতিথিকে জিম্মি করে ১৭ বিদেশি ও তিন বাংলাদেশিসহ ২০ জনকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। রাতে পুলিশ-র্যাবের যৌথ অভিযানে জঙ্গিদের গুলি ও গ্রেনেড হামলায় ৩৩ পুলিশ, আনসার ও র্যাব সদস্য আহত হন। এদের মধ্যে সহকারী কমিশনার রবিউল করিম ও বনানী থানার ওসি সালেহ উদ্দিন রাতেই মারা যান। পরদিন সকালে সেনাবাহিনীর নেতৃত্বে যৌথ অপারেশনে ৫ জঙ্গিসহ ৬ নিহত হয়।
বাংলাদেশে সংঘটিত এ জঙ্গি হামলাটি সারা বিশ্বে ঘটা বড় বড় জঙ্গি হামলাগুলোর মধ্যে অন্যতম আলোচিত ঘটনা। ঘটনার রাত ও পরে বিশ্ববাসীর নজর ছিল ঢাকার এই ঘটনার দিকে। ঐ সময়ে মধ্যপ্রাচ্যে গজিয়ে ওঠা চরমপন্থী সংগঠন আইসিস এর রমরমা অবস্থা। তারা বিশ্বজুড়েই নানা নৃশংস ঘটনার জন্ম দিয়ে যাচ্ছিল। ঠিক সেই সময়ে তাদের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যই হত্যকারী তরুণ জঙ্গিগুলোগুলো এ অভিযানে নামে। ইসলামের নামে গজিয়ে ওঠা এসব উগ্রপন্থীরা মূলত ধর্মীয় বিকৃত ব্যাখ্যা দ্বারা উদ্ভুদ্ধ হয়ে মানুষ হত্যায় মেতে উঠেছিল। অর্থাৎ এদের পেছনে একটা আদর্শ কাজ করেছে। যে কারণে তারা আত্মঘাতী হতেও দ্বিধা বোধ করে না। কিন্তু তাদের এ আদর্শ ছিল ভুল আদর্শ। যে কারণে মধ্যপ্রাচ্যসহ আমাদের দেশের এসব ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা বর্তমানে একেবারে নির্মূলের পথে। মানুষ মেরে ধর্মপালন, নৃশংসতা চালানোর নীতিকে সাধারণ মানুষও সমর্থন করেনি। যে কারণে তারা কোথাও সহযোগিতা না পেয়ে ধরাশায়ী হয়ে জেল খাটছে।
আত্মঘাতী নীতিতে (ধর্মীয় বিকৃত নীতি) উদ্বুদ্ধ সন্ত্রাসীদের নির্মূল করা সহজ কোনো কাজ ছিল না। তবে বেশকিছু সামাজিক ও ধর্মীয় আদর্শভিত্তিক দল এদের আদর্শকে বিকৃত ও অগ্রহণযোগ্য আদর্শ হিসেবে প্রমাণ করে দেওয়ার কাজটি করে দেওয়ায় সাধারণ মানুষের মনে সন্ত্রাসীদের ব্যাপারে নেতিবাচক ধারণার সৃষ্টি হয়। সেই সাথে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সশস্ত্র মোকাবেলা- এই দুইয়ের সম্মিলনেই আজ এ সফলতা এসেছে। দুই পক্ষকেই আমরা অভিনন্দন জানাই। একই সাথে প্রত্যাশা করি, অভিযোগপত্রে যাদের নাম উঠে এসেছে তারা আইনের দ্বারা যথাযথ শাস্তির মুখোমুখি হবে এবং যারা পলাতক রয়েছে তাদেরকেও আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এভাবেই ভবিষ্যতে ধর্মের নামে উগ্রবাদের উত্থান একদিন পুরোপুরি বন্ধ হবেই হবে।