রংপুর: একদিকে ট্যানারি মালিকদের কাছ থেকে পাওনা, অব্যাহত লোকসানে পড়ে চরম আর্থিক সঙ্কটে পড়েছে উত্তরের ৮ জেলার চামড়া ব্যবসায়ীরা। আট জেলার প্রায় দুই হাজার চামড়া ব্যবসায়ী তাদের পাওনা প্রায় দেড়’শ কোটি টাকা আদায় করতে না পারায় চলতি মৌসুমে এসে চরম অর্থাভাবে পড়েছেন। কাজ হচ্ছে না ট্যানারি মালিকদের দফায় দফায় চাপ দেয়ার পরও। এবার অর্থ সংগ্রহ করতে না পারলে তাদের পক্ষে চামড়া ক্রয় করা সম্ভব হবে না। অন্যদিকে এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে ভারতের চামড়া ব্যবসায়ীরা এ অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিয়ে দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছে কোটি কোটি টাকা। পাশাপাশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে পাচারকারী দলের সদস্যরাও। ফলে সীমান্ত জেলা দিয়ে এবার ছাগলের চামড়ার পাশাপাশি গরুর চামড়াও পাচারের আশংকা করছেন ব্যবসায়ীরা। সবমিলিয়ে চরম হতাশ এ অঞ্চলের চামড়া ব্যবসাীয়রা। তাদের আশঙ্কা এবার কোরবানী ঈদে চামড়ার বাজারে ধস নামার আশঙ্কা করছেন তারা।
বিভাগীয় পুলিশ কমিশনার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, চামড়া পাচার রোধে প্রশাসনের পক্ষ থেকে সীমান্ত এলাকায় সব ধরনের প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। চামড়া পাচার রোধে সীমান্তের যে সকল এলাকায় কাঁটা তারের বেড়া নেই এবং অরক্ষিত সেসকল এলাকায় বিজিবিকে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রাখা হবে। ওইসব এলাকায় টহল জোরদার করাসহ দিন-রাত সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থান রাখা হবে। এছাড়া ওইসব এলাকায় নজরদারি জোরদার করা হয়েছে।
পুলিশের রংপুর রেঞ্জের ডিআইজি দেবদাস ভট্টাচার্য্য জানান, চামড়া পাচার রোধে প্রশাসন সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় রয়েছে। চামড়ার ট্রাক কোনো সীমান্ত যেন অতিক্রম করতে না পারে সে ব্যাপারে সীমান্তে বিশেষ ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। যে সকল রুটে চামড়া পাচারের আশঙ্কা রয়েছে সেখানে বিশেষ চেকপোস্ট বসিয়ে তল্লাশি করা হবে। কোন অবস্থায় রংপুর বিভাগের সীমান্ত দিয়ে কোন চামড়া পাচার করতে দেয়া হবে না।
#ট্যানারি মালিকদের কাছে পাওনা দেড়’শ কোটি টাকা #ব্যাংক ঋণ না পেয়ে দাদন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিচ্ছেন ব্যবসায়ীরা #ভারতীয় ব্যবসায়ীরা এ দেশের ফড়িয়া দালালদের হাতে তুলে দিচ্ছে কোটি কোটি টাকা #চামড়া পাচার রোধে সর্বোচ্চ সতর্কাবস্থায় প্রশাসন’
চামড়া ব্যবসায়ী মালিক সমিতি সূত্রে জানা যায়, রংপুর বিভাগের ৮ জেলার ছোট-বড় মিলে চামড়া ব্যবসায়ীর সংখ্যা প্রায় ২ হাজার। এর মধ্যে রংপুর জেলায় চামড়া ব্যবসায়ী রয়েছেন প্রায় ৩’শ। এদের মধ্যে আড়তদার রয়েছেন প্রায় ১’শ জন। ঢাকার ট্যানারি মালিক ও নাটোরের আড়তদারদের কাছে রংপুর বিভাগের চামড়া ব্যবসায়ীর বকেয়া পাওনা রয়েছে প্রায় দেড়’শ কোটি টাকা। এর মধ্যে রংপুর জেলার চামড়া ব্যবসায়ীদের পাওনা রয়েছে ৪০ কোটি ৩০ লাখ টাকা। এই বকেয়া পাওনা আদায়ে দফায় দফায় চাপ দেওয়া হলেও টাকা পরিশোধের ব্যাপারে তাদের কোন আগ্রহ নেই বলে অভিযোগ করেছেন ব্যবসায়ীরা।
ছোট ব্যবসায়ী ও ফড়িয়া দালালদের কাছ থেকে চামড়া কিনে বড় বড় ব্যবসায়ীরা ঢাকার বিভিন্ন ট্যানারিতে সরবরাহ করে থাকেন। কিন্তু এবারে আর্থিক সঙ্কটের কারণে বড় ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি ছোট ব্যবসায়ী ও ফড়িয়া দালালরাও দিশেহারা হয়ে পড়েছেন। এই সুযোগে ভারতীয় ব্যবসায়ীরা রংপুর-দিনাজপুর অঞ্চলের সীমান্ত এলাকায় অবস্থান নিয়ে এদেশের ফড়িয়া দালালদের হাতে আগাম টাকা তুলে দিচ্ছেন বলে জানা গেছে। এদিকে পুঁজি সঙ্কটের কারণে প্রায় ২’শ ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। চামড়ার আড়তে এখন অটো বাইকের শোরুম করা হয়েছে।
রংপুর নগরীর চামড়ার মোকাম শাপলা চত্বরের চামড়া পট্টির ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, পুঁজি সঙ্কটের কারণে অনেক ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা গুটিয়ে অন্য ব্যবসা শুরু করেছেন। দীর্ঘদিনের চামড়ার আড়তে এখন অটোরিকসার শো-রুম দিয়ে বসেছেন ব্যবসায়ীরা। ১০/১২ জন চামড়া ব্যবসায়ী কোন রকমে চামড়ার ব্যবসা ধরে রেখেছেন। চামড়া ব্যবসায়ী মতিউর রহমান চৌধুরী, মতিয়ার রহমান, মজিবর রহমান, আবুল খায়েরসহ বেশ কয়েকজনের সাথে কথা হলে তারা জানান, কোরবানীর ঈদের আগেই চামড়ার বাজারে ধস নেমেছে। প্রকার ভেদে গরুর চামড়া ৫’শ টাকা থেকে দেড় হাজার টাকা এবং ছাগলের চামড়া ৮০ থেকে ১০০ টাকায় কেনা হচ্ছে।
চামড়া ব্যবসায়ী হারুন অর রশীদ জানান, চামড়া ব্যবসায় অব্যাহত লোকসানের কারণে আমি নিঃস্ব হয়ে গেছি। জীবন-জীবিকার তাগিদে চামড়া ব্যবসা বাদ দিয়ে ব্যাংক ঋণ নিয়ে ব্যাটারী চালিত অটো রিকসার ব্যবসা শুরু করেছি। চামড়া ব্যবসায় অব্যাহত লোকসানে পড়ে বেশীর ভাগ চামড়া ব্যবসায়ীই চামড়া ব্যবসা ছেড়ে দিয়ে অন্য কাজ করছেন। তিনি জানান, চামড়া ব্যবসায় লোকসানের কারণে বর্তমানে চামড়া পট্টিতে ১০/১২ জন ব্যবসায়ী তাদের ব্যবসা টিকে রেখেছেন। আগে যেখানে ১’শ থেকে দেড়’শ ব্যবসায়ী ছিল। এ অবস্থায় পবিত্র ঈদুল আযহার আর মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকলেও এখন পর্যন্ত ব্যাংক ঋণ মেলেনি ব্যবসায়ীদের। এ অবস্থায় সরকারকে দ্রুত ব্যবস্থা নেয়ার জন্য অনুরোধ জানিয়েছেন রংপুর জেলা চামড়া ব্যবসায়ী সমিতির নেতা লতিফ খান, মহসিন আলমসহ অন্যান্য ব্যবসায়ীরা।