দীর্ঘ অনেকদিন যাবৎ রংপুর তথা উত্তরাঞ্চলের লোকদেরকে রাজধানীতে অনেকে ব্যাঙ্গ করে ‘মফিজ’ নামে ডকেন। কতদিন যাবৎ তা জানা নেই কারও। তবে কেউ কেউ মনে করেন আশি বা নব্বই দশকের কোন একসময় থেকে এ প্রচলন শুরু হয়েছে। বর্তমানে এই শব্দটা সারাদেশে বিশেষ করে ঢাকা বা গাজীপুরে বেশি প্রচলিত। এখন শুধু উত্তরবঙ্গের লোকজনকেও নয়, ইদানীং সহজ-সরল বা কম চালাক মানুষদেরকেও মফিজ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। এটা বেশ প্রচলিত হয়েছে বা হচ্ছে, বলা হয় ‘মফিজ কোথাকার?’ মফিজ, ‘তুইতো দেখি রংপুরের মফিজ’, ‘তুইকি রংপুরের মফিজ নাকি’ ইত্যাদি।
মফিজ কেন বলা হয় ? -এটা নিয়ে আমরা কেউ তেমন কিছু জানিনা বা অনেকেই জানেন। অনেক সময় জানতে ইচ্ছে করে যে কেন মফিজ বলা হয় উত্তরবঙ্গের মানুষদের। রংপুরের বা উত্তরাঞ্চলের মানুষকে মফিজ বলা নিয়ে অনেক রকমের গল্প প্রচলিত আছে। যেগুলোর সত্যতা যাচাই করা যায় নি যে, মফিজ নামে কাউকে কেন্দ্র করেই এই নামকরণ নাকি কম চালাক মানুষদের ঠাট্টা করার জন্য এটি নিছকই একটি প্রচলন মাত্র।
গাইবান্ধা জেলার একজন মফিজ কে কেন্দ্র করে। যেখানে গরিব-দিনমজুর শ্রেণির উপকারী বন্ধু মফিজ।
মফিজ উপাখ্যান নিয়ে যে গল্পগুলো প্রচলিত তার মধ্যে একটি গাইবান্ধা জেলার একজন মফিজ কে কেন্দ্র করে। যেখানে গরিব-দিনমজুর শ্রেণির উপকারী বন্ধু মফিজ। বলা হয়, গাইবান্ধার কোন এক গ্রামের সহজ-সরল, সৎ একজন ড্রাইভার ছিলেন। তার নাম ছিল মফিজ। আমরা তাকে মফিজ সাহেব হিসেবে উল্লেখ করবো। মফিজ সাহেব তার জমানো টাকা দিয়ে একবার ঢাকা-গাইবান্ধা রুটে একটি বাস চালু করেন। মানবদরদী মফিজ সাহেব নূন্যতম ভাড়ায় দিনমজুর লোকেদের ঢাকায় নিয়ে যেতেন। কালক্রমে একসময় মফিজ সাহেব নিজের আর গাড়ি চালাতেন না। তিনি তখন অন্য ড্রাইভার দিয়ে গাড়ি যাতায়াতের ব্যবস্থা রাখলেন। এদিকে দিনমজুর গরিব লোকজন ভাড়া সাশ্রয়ের জন্য মফিজ সাহেবের বাড়িতে যায় স্বল্প ভাড়ায় তাদের ঢাকায় যাতায়াতের ব্যবস্থা করতে।
ফলে মফিজ সাহেব তাদের স্বল্প ভাড়ায় যাতায়াতের জন্য দিনমজুর শ্রেণিটিকে তার নিজের নামের স্বাক্ষর (অর্থাৎ ‘মফিজ’) করে কাগজ দিতেন। যা সুপারভাইজারকে দেখিয়ে নামমাত্র ভাড়ায় মফিজ সাহেবের বাসের ছাদে যাতায়াত করতেন তারা। আর বাস যাতায়াতের পূর্বে বাসের সুপারভাইজার ছাদে যাতায়াতের কয়জনকে বুঝাতে মফিজের কয়জন? আছে তাদেরকে ডাক দিতেন। সময়ক্রমে সুপারভাইজার ডাক দিতেন কতজন মফিজ আছে। এভাবেই পরবর্তীতে বাসের ছাদে যাতায়াতকারী লোকেদেরকে মফিজ নামে ডাকা হয়। যা পরবর্তীতের রংপুর বা কুড়িগ্রাম সহ উত্তরাঞ্চল থেকে বাসের ছাদে যাতায়াতকারীদেরকে বলা হতো। পরবর্তীতের উত্তরাঞ্চলের সহজ-সরল বা কম চালাক মানুষদেরকেও মফিজ বলা শুরু হলো। এর পরবর্তীতে যা ঘটলো তা হলো, একশ্রেণির লোক উত্তরাঞ্চলের মানুষ বলতেই মফিজ বলা শুরু করলো। যা এখনও প্রচলিত।
আরও পড়ুন: অনেক বদলেছে উত্তরবঙ্গ
আরও একটি ঘটনা আছে। যেখানেও মফিজ উদ্দিন নামে একজনকে পাওয়া যায়। যার ভূমিকাও অসহায়, গরিব-দু:খী মানুষের বন্ধুরুপে। এটা জ্ঞাতব্য যে, উত্তরাঞ্চল বিশেষ করে কুড়িগ্রাম জেলা বেশ বন্যা প্রবণ এলাকা। প্রচলিত গল্প অনুযায়ী ঘটনাটি আশির দশকের কোন বন্যা পরবর্তী। সেটা অষ্ট আশির বন্যা কিনা তা জানা যায় নি, হয়তোবা নয়। সেসময় কুড়িগ্রামের প্রায় সব উপজেলায় খুব বড় আকারের বন্যা হয়। বন্যায় ওইসব বন্যা কবলিত এলাকার মানুষ বাড়ি-ঘর, জমিসহ সবকিছু হাড়িয়ে অত্যান্ত কষ্টে দিন যাপন করছিল। একসময় ওইসব মানুষ অভাবের তারণায় জীবিকার তাগিতে কাজের সন্ধানে ঢাকায় পাড়ি জমায়। ওইসময় ঢাকায় যাওয়ার জন্য তারা প্রথমে রংপুরের মডার্ণ বাসস্ট্যান্ড এ আসে ঢাকায় যাওয়ার বাস ধরতে।
ওইসময় বাস কম ছিল। বলা হয় যে, যানবাহন কম হলেও দালাল (চেনমাস্টার) ছিল অনেক। দালালদের মধ্যে একজনের নাম ছিল মফিজ উদ্দিন। যিনি ওই মানুষদের অনুরোধে অর্ধেক ভাড়ায় বাসের ছাদে করে কুড়িগ্রামের যাতায়াতের ব্যবস্থা করতেন। আর এভাবেই বাসের ছাদে ঢাকায় যাওয়ার সুযোগ এ অঞ্চলের অনেক মানুষ নিতে লাগলেন। সময়ক্রমে বাসের সাথে সংশ্লিষ্ট সুপাভাইবার বা হেলপাররা বাসের ছাদে যাতায়াতকারী বোঝাতে মফিজের কতজন? (মফিজ উদ্দিনের দেওয়া যাত্রী কতজন), পরবর্তীতে কতজন মফিজ আছে? ইত্যাদি বাক্যের প্রচলন শুরু করেন। ফলে বাসের ছাদে যাতায়াতাকারীরা ‘মফিজ’ আখ্যা পেয়ে যান। আর পরবর্তীতে গোটা উত্তরাঞ্চলের মানুষদেরকেই মফিজ বলে আখ্যা দেওয়া হয়। যা এখনও প্রচলিত।
উপরের ঘটনা ছাড়াও অনলাইনে ঘেটে এক ব্লগারের পোস্টে অন্য একটি তথ্য পাওয়া গেল। মফিজ শব্দটি নাকি মপীজ এর বিকৃতরুপ। মপীজ অর্থ বলা হয়েছে মঙ্গা পীড়িত জনগন। উত্তরাঞ্চল একসময় খুবই মঙ্গা পীড়িত অঞ্চল ছিল। সেসময় উত্তরবঙ্গের লোকেদের জন্য ওই ক্যাটাগরিতে সাহায্য বরাদ্দ থাকতো। তারই বিকৃতরুপ মফিজ। যদিও বর্তমানে উত্তরবঙ্গের লোকদের অনেক উন্নতি হয়েছে তবুও সেই আগের নামটি রয়েই গেছে।
উপরের কোন ঘটনারই বাস্তবে কোন ভিত্তি আছে কিনা বা সঠিক কিনা তা যাচাই করা সম্ভব হয় নি। মফিজ সাহেব বা মফিজ উদ্দিন নামের কাররই বর্তমানে উপস্থিতি নেই। তারা এখনও জীবিত নাকি মৃত, তাও নিশ্চিত হওয়া সম্ভব নয়। কেননা যারা এসব ঘটনা বলছেন, তারা নির্দিষ্ট সময় বা কোন এলাকার/কে তা উল্লেখ করছেন না। আবার মফিজ উপাখ্যানের জন্য প্রাসঙ্গিক দুই স্থানে প্রায় একই ঘটনাও ভাববার বিষয়! তবে এমনও হতে পারে দুই ঘটনাই সত্য দুটি ভিন্ন ভিন্ন প্রেক্ষাপটে! আসলেই ‘মফিজ’ নামকরণের সঠিক ইতিহাস কি?