রংপুর এক্সপ্রেস: বিদেশী ক্রেতারা বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা কমিয়ে দিয়েছে। ফলে দেশি চামড়ার মান ও জোগান ভালো এবং শ্রমব্যয় কম হওয়া সত্ত্বেও দিন দিন চামড়া খাত গুরুত্বহীন হয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে চামড়া রফতানির লক্ষ্যমাত্রা কমিয়েও ধস ঠেকানো যাচ্ছে না। অথচ চামড়া ছিল দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি আয়ের খাত। মূলত চামড়া সংগ্রহ ব্যবস্থাপনায় অরাজকতা আর পরিবেশবান্ধব উপায়ে প্রক্রিয়াজাত না হওয়ায় এমন সঙ্কট তৈরি হয়েছে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক ক্রেতা প্রতিষ্ঠানের চাপে দেশি বড় প্রতিষ্ঠানগুলোকে বিদেশ থেকে চামড়া এনে পণ্য রপ্তানি করতে হচ্ছে। চামড়া শিল্প সংশ্লিষ্টদের সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সূত্রমতে, দেশের চামড়াশিল্পকে টেকসই করতে পরিবেশবান্ধব উপায়ে পণ্য উৎপাদনে সরকার উদ্যোগ নিলেও তা যথাযথ বাস্তবায়িত হয়নি। ফলে সরকার ২০২১ সালে চামড়া খাত থেকে ৫শ কোটি ডলার রপ্তানি আয়ের যে লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে, তা অধরাই থেকে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আর এবারের কোরবানি পশুর চামড়া সংগ্রহ ও দরপতন ওই আশঙ্কাকে আরো গভীর করেছে। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে দেশের আয় হয়েছে ১০৮ কোটি ডলার। ওই আয় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২১ শতাংশ কম। তার আগের বছরের চেয়েও ওই আয় ১২ শতাংশ কম। আর সদ্যবিদায়ী অর্থবছরের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৩৮ কোটি ডলার। কিন্তু নেতিবচাক প্রবৃদ্ধির ফলে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চলতি অর্থবছরের (২০১৮-১৯) লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে ১১২ কোটি ডলার, যা গত অর্থবছরের চেয়ে ২৬ কোটি ডলার কম। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসেও (জুলাই) চামড়া শিল্পের রপ্তানি আয়ের লক্ষ্যমাত্রা ও প্রবৃদ্ধি দুটিই কম হয়েছে। ওই সময়ে আয় হয়েছে ৯ কোটি ১১ লাখ ডলার (৮১০ কোটি ৬০ লাখ টাকা), যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৫.৫৫ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়েও ওই আয় ২১.৭৩ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের জুলাই মাসে এই খাত থেকে আয় হয়েছিল ১১ কোটি ৬৪ লাখ ৭০ হাজার মার্কিন ডলার।
সূত্র জানায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রপ্তানিতে আয় হয়েছিল ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরে ওই খাতে রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ১১২ কোটি ৪০ লাখ ডলার। চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে ওই খাতের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ কোটি ৬৫ লাখ ২০ হাজার ডলার। ওই মাসে কাঁচা চামড়া রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা ছিল এক কোটি ৫৮ লাখ ডলার। অথচ রপ্তানি আয় হয়েছে এক কোটি ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৩৬.২০ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের জুলাই মাসে কাঁচা চামড়া রপ্তানি করে আয় হয়েছিল এক কোটি ৩৩ লাখ ২০ হাজার ডলার। আগের অর্থবছরের প্রথম মাসের তুলনায়ও চলতি অর্থবছরের প্রথম মাসে কাঁচা চামড়ার রপ্তানি আয় ২৪.৩২ শতাংশ কম। ওই সময়ে চামড়াজাত পণ্য রপ্তানি করে আয় হয়েছিল এক কোটি ৪৮ লাখ ৪০ হাজার ডলার। চলতি অর্থবছরের জুলাই মাসে চামড়া খাতের পণ্য রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা ছিল দুই কোটি ৯২ লাখ ডলার। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে আয় কম হয়েছে ৪৯.১৮ শতাংশ। ওই আয় আগের অর্থবছরের জুলাই মাসের চেয়ে ৬১.৪৯ শতাংশ কম। তবে ২০১৮-১৯ অর্থবছরের জুলাই মাসে চামড়ার জুতা রপ্তানিতে লক্ষ্যমাত্রা ও প্রবৃদ্ধি দুই ভালো হয়েছে। ওই সময়ে আয় হয়েছে ৬ কোটি ৬২ লাখ ৪০ হাজার ডলার, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ২৮.৫৭ শতাংশ বেশি।
এদিকে দেশের চামড়া শিল্পের অবস্থা সম্পকে চামড়াজাত পণ্য ও পাদুকা প্রস্তুত ও রপ্তানিকারকদের সংগঠন এলএফএমইএবির সভাপতি সাইফুল ইসলাম জানান, দেশের চামড়াশিল্পের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে এবং পরিবেশবান্ধব উপায়ে প্রক্রিয়াজাত করতে হাজারীবাগ থেকে ট্যানারিগুলো সাভারে নেয়া হয়। কিন্তু চামড়া নগরীর কেন্দ্রীয় বর্জ্য শোধানাগার (সিইটিপি) কার্যকর না হওয়ায় এই খাতে চরম নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। তবে দেশি কিছু প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ইটিপি থাকার ফলে রপ্তানি আয় এখনো কিছুটা সচল থাকলেও এই শিল্পকে রক্ষা করতে এখনই চামড়া নগরীর সিইটিপি কার্যকর করা জরুরি। সেজন্য চীনা প্রতিষ্ঠানের কাজ বাতিল করে তৃতীয় কোনো দেশের কারিগরি সহায়তা নিয়ে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে।
অন্যদিকে একই প্রসঙ্গে রপ্তানিকারদের সংগঠন ইএবির সভাপতি আব্দুস সালাম মুর্শেদী জানান, পরিবেশবান্ধব চামড়া শিল্প তৈরি করা না গেলে দেশের সম্ভাবনাময় চামড়া খাতের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়বে। বাংলাদেশে চামড়ার মান ভালো, শ্রমব্যয় কম হওয়ার পরও এর সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। দিন দিন মুখ থুবড়ে পড়ছে। পাশাপাশি চীন-যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্যযুদ্ধের পর বাংলাদেশ থেকে চামড়া কেনা কমিয়েছে বিদেশি ক্রেতারা। অন্যদিকে পরিবেশবান্ধব উপায়ে চামড়া প্রক্রিয়াজাত না হওয়ায় বিদেশি ক্রেতারা দেশি বড় ব্র্যান্ড কম্পানিগুলোকে বিদেশ থেকে চামড়া আমদানি করে পণ্য রপ্তানি করার পরামর্শ দেন। ফলে সাভারের চামড়া শিল্প নগরীকে পরিবেশবান্ধব করা না গেলে সম্ভাবনাময় খাতটিকে দেশের সোনালি আঁশ পাটের পরিণতি ভোগ করতে হবে।
চামড়া কিনেছেন ৪০০-৫০০, বাজারমূল্য ২০০-৩০০
চামড়া জাতীয় বাজারমূল্যরংপুর এক্সপেস: ঈদুল আজহায় সারাদেশে বিপুল সংখ্যক পশু কোরবানি হয়েছে। ঈদের পরদিনও দেশের শহরগুলোর অনেকস্থানে পশু কোরবানি হয়েছে। আর কোরবানি শেষে পশুর চামড়া নিয়ে চলছে টানা-হেচড়া। রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে মৌসুমী ব্যবসায়ীরা চামড়া নিয়ে রাজধানীর লালবাগের পোস্তায় অপেক্ষা করছেন ভালো দামের আশায়। কিন্তু বাজারমূল্য যা তাতে ব্যবসায়ীদের মাথায় হাত পড়ার অবস্থা। যে চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনেছেন বাজারে পাইকাররা তার দাম বলছে মাত্র ৩০০ টাকা। ঈদের পরদিন আজ বৃহস্পতিবার রাজধানীর চামড়ার পাইকারি বাজার লালবাগের পোস্তায় গিয়ে সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এমনটাই জানা গেছে।
সিলেট থেকে নুরুল হক দুই ট্রাক চামড়া নিয়ে পোস্তায় এসেছেন লাভের আশায়, লাভ তো দূরের কথা বিক্রিই করতে পারছিলেন না চামড়াগুলো। প্রতিটি চামড়া ৪০০ থেকে ৫০০ টাকায় কিনেছেন বলে জানান তিনি। এই ব্যবসায়ী বলেন, কিন্তু এখন পোস্তায় ব্যবসায়ীরা দাম বলছেন মাত্র ৩০০ টাকা করে। নুরুল হক বলেন, সকাল ১০ টায় দুই ট্রাক মাল (চামড়া) নিয়ে পোস্তায় এসেছি। দুই-একজন দাম বললেও দেওয়ার মতো না। কিনেছি ৫০০ টাকায় এখন দাম বলে ৩০০ টাকা, গাড়ি ভাড়া দিয়ে এনেছি সেই টাকাও তো উঠবে না। এবার ব্যবসা করে পুরাই ধরা।
একই দশা নরসিংদীর মনোহরদীর আরেক ব্যবসায়ী মিয়া হোসেনেরও। তিনি ৩৪০ টি চামড়া দুই ভাগে বিক্রি করেছেন। তার ২১০ টি চামড়া বিক্রি হয়েছে ৩১০ টাকা করে আর ১৩০ টির দাম পেয়েছেন ৩০০ টাকা করে।
মিয়া হোসেন বলেন, “ঈদের দিন দুপুরের দাম শুনে মাল কিনেছিলাম। এখানে এসে দেখি কেউ জিগায়-ই না। অনেক অনুরোধ করে ৩৪০ টি মাল বিক্রি করেছি। ১৩০ টির দাম এখনো হাতে পাইনি। পচনশীল মাল এখন বিক্রি করতে না পারলে ফেলে দিতে হবে। তাই যে দাম বলছে দেওয়া ছাড়া উপায় নাই।” দাম কমের কথা স্বীকার করলেন আড়তদার লোকমান হোসেন। তিনি বলেন, ঈদের দিন দুপুরে ভালো দাম গেছে। রাত থেকে মাল কেনার লোক নাই। শুধু নিলে তো হবে না আগের মালগুলো লবণ মাখাতে না পাড়লে পচন ধরবে, তাই এখন বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি লবণ দেওয়ায়।
ঈদের দিন দুপুরে যে চামড়া ১২০০ টাকায় বিক্রি হয়েছে, সেই একই আকারের চামড়া এখন ৬০০ টাকাও বলছে ব্যবসায়ীরা। আর সরকার নির্ধারিত দাম তো ধারে কাছেও নাই। ক্রেতা-বিক্রেতা কেউ সরকারি দাম মানছেন না। নরসিংদীর জামিয়া ইসলামিয়া লক্ষ্মীপুরা রহমতপুর মাদ্রাসার ছাত্র মোবারক হোসেন ১২৫ টি চামড়া বিক্রি করেছিলেন ৬২০ টাকা করে। মাদ্রাসায় তার শিক্ষক ওমর ফারুকের কাছে বিক্রি করেছিলেন বাকিতে। কথা ছিল চামড়া বিক্রি করে টাকা দেবে। “আমি খোঁজ নিয়ে এসেছি, আইসা দেখি মালই বিক্রি করতে পারেননি, টাকা দিব কেমনে। একটু আগে একজন ২০০ টাকা পিচ বলেছে; এখন সেও নাই। দাম বলে কেউ নেয়না।”