রেলপথ মন্ত্রণালয় আখাউড়া থেকে সিলেট পর্যন্ত মিটারগেজ রেললাইনকে ডুয়েলগেজ করার উদ্যোগ নিয়েছে। তার জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা। কিন্তু পরিকল্পনা কমিশন ওই ব্যয় প্রস্তাবকে অস্বাভাবিক বলে আপত্তি জানিয়েছে। জিটুজি পদ্ধতিতে চীন সরকার ওই প্রকল্পে ১০ হাজার ২৬৭ কোটি টাকা ঋণ দিচ্ছে। বাকি ৫ হাজার ৪৩৮ কোটি টাকা সরকারি তহবিল থেকে জোগান দেয়া হবে। অথচ ওই প্রকল্প ৫ হাজার কোটি টাকা দিয়েই বাস্তবায়ন সম্ভব। মূলত ওই প্রকল্পে অস্বাভাবিক ব্যয় দেখিয়ে টাকা লুটপাটের ব্যবস্থা করা হচ্ছে। আর সেজন্যই দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন ব্যয় অন্যান্য দেশের তুলনায় বেশি হচ্ছে। ঋণের টাকায় ওই প্রকল্প বাস্তবায়ন করে কোনো লাভ হবে না বলে পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্টরা মনে করছে। পরিকল্পনা কমিশন সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, আখাউড়া-সিলেট ডুয়েলগেজ লাইন হলে ট্রেন চলাচলের হার (ফ্রিকোয়েন্সি) বাড়বে না। তবে ওই রুটে ডাবল লাইন এবং ডুয়েলগেজ নির্মাণ করা হলে ওই প্রকল্প থেকে সুবিধা পাওয়া যাবে। তা নাহলে সরকারের ওই বিশাল বিনিয়োগে জনগণের তেমন কোনো সুবিধা হবে না। প্রকল্পে ব্যালাস্ট (পাথর), স্লিপার, রেলসহ অন্যান্য উপকরণের পরিমাণ ও ব্যয় চলমান সমজাতীয় অন্যান্য প্রকল্পের তুলনায় অনেক বেশি। সব মিলিয়ে প্রকল্পের প্রস্তাবিত ব্যয় সমজাতীয় ৪টি প্রকল্পের তুলনায় প্রায় ৭ গুণ বেশি। এতো ব্যয়ে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন আদৌ সমীচীন হবে না তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কারণ প্রস্তাবিত প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি নির্মাণ ব্যয় ধরা হয়েছে ৫৬ কোটি ৭২ লাখ টাকা। অথচ আখাউড়া থেকে লাকসাম পর্যন্ত ডুয়েলগেজ ডাবল রেললাইন নির্মাণ এবং বিদ্যমান রেললাইনকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরে চলমান প্রকল্পে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় হচ্ছে ২৪ কোটি ৮০ লাখ টাকা। কিলোমিটারপ্রতি ছয় কোটি ৮৩ লাখ টাকা ব্যয়ে নির্মিত হচ্ছে ঈশ্বরদী থেকে পাবনা ঢালারপর পর্যন্ত নতুন রেলপথ। তাছাড়া মধুখালী থেকে কামারখালী হয়ে মাগুরা পর্যন্ত ব্রডগেজ রেলপথ নির্মাণে কিলোমিটারপ্রতি ব্যয় ধরা হয়েছে ১৩ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ সেকশনে মিটারগেজ রেললাইনের সমান্তরাল আরেকটি ডুয়েলগেজ রেললাইন নির্মাণে ব্যয় মাত্র ৮ কোটি ৭৫ লাখ টাকা।
সূত্র জানায়, ব্রিটিশ আমলে আসাম বেঙ্গল রেলওয়ে আসাম ও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মধ্যে কৌশলগত যোগাযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ১৮৯৮ সালে প্রথম করিমগঞ্জ-শাহবাজপুর-কুলাউড়া-আখাউড়া-চট্টগ্রাম সেকশনে রেললাইন স্থাপিত হয়। শাহবাজপুর-কুলাউড়া-আখাউড়া সেকশনটি ট্রান্স এশিয়ান রেলওয়ের একটি সাব-রুট। মহীশ্মসান (ভারত) ও শাহবাজপুরের (বাংলাদেশ) মধ্যে সংযোগ স্থাপনের লক্ষ্যে ভারতীয় ক্রেডিট লাইনের (এলওসি) আওতায় সেকশনটি পুনর্বাসনের জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়নাধীন রয়েছে। তাছাড়গা ঢাকা-চট্টগ্রাম করিডোরকে ডুয়েলগেজে রূপান্তরের কাজ চলমান রয়েছে। আখাউড়া-লাকসাম ডুয়েলগেজ ডাবল লাইন নির্মাণকাজও শুরু হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রামে করিডোরের বাকি অংশ ডুয়েলগেজে রূপান্তরের লক্ষ্যে একটি সমীক্ষা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। ভারতীয় অনুদানে আগরতলা ও আখাউড়ার মধ্যে ১০ কিলোমিটার রুটে আরেকটি ডুয়েলগেজ লিংক স্থাপনের প্রক্রিয়াও চলমান রয়েছে। ওসব কাজের সঙ্গে সমন্বয় রাখতে আখাউড়া-সিলেট সেকশনটি ডুয়েলগেজে রূপান্তরের লক্ষ্যেই সিলেট-আখাউড়া ডুয়েলগেজ রেললাইন প্রকল্পটির প্রস্তাব করা হয়েছে। বিগ০ত ২০১৫ সালে প্রকল্পটি বাস্তবায়নে চায়না রেলওয়ে ব্রিজ ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যুরো গ্রæপ কোম্পানির সঙ্গে বাংলাদেশ রেলওয়ের একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। তারপরই প্রকল্পের প্রাথমিক প্রকল্প প্রস্তাবনা (পিডিপিপি) তৈরি করা হয়। আর তা ২০১৬ সালে অনুমোদিত হয়। পরে বিশেষ অগ্রাধিকার প্রকল্প বিবেচনা করে প্রকল্পটি সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে বাস্তবায়নের জন্য অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় অনুমোদিত হয়। প্রকল্পটি মোট ১৫ হাজার ৭০৫ কোটি টাকা ব্যয়ে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের জুন মেয়াদে বাস্তবায়নের কথা রয়েছে।
সূত্র আরো জানায়, পরিকল্পনা কমিশন সিলেট-আখাউড়া ডুয়েলগেজ রেললাইন প্রকল্পের ভৌত কাজের জন্য প্রতিযোগিতা ছাড়া এক ঠিকাদারের মাধ্যমে সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে আপত্তি জানিয়েছে। কমিশনের মতে, চীনের অন্যান্য দরদাতা পতিষ্ঠানের জন্যও দরপত্রে অংশগহণের সুযোগ রাখতে হবে। সরাসরি ক্রয় পদ্ধতিতে চীনের একটি পতিষ্ঠানের মাধ্যমে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেনে করার সিদ্ধান্ত ছিল। কিন্তু ওই পকল্পে অনেক বেশি ব্যয়ের প্রস্তাব করা হয়। ওই কারণে শেষ পর্যন্ত চীনের অর্থায়নে পকল্পটি বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত বাতিল করে অর্থ মন্ত্রণালয়।
এদিকে যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে জিটুজি পদ্ধতিটাই সমস্যা। ওই পদ্ধতি চীনের একক কোনো পতিষ্ঠান কাজ পায়। তারাই ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করে। তার আগে বিমান ও সড়কের পকল্পেও ওই ধরনের সমস্যা হয়েছে। ব্যয় বেশি ধরায় চীনের অর্থায়নে ঢাকা-সিলেট মহাসড়ক চার লেন উন্নয়ন প্রকল্প থেকে সরে আসতে বাধ্য হয়েছে সরকার। এমন বিষয়ে সরকারকে সতর্ক থাকতে হবে। একবার ওই ফাঁদে পড়লে বাংলাদেশের পক্ষে আর ওঠা সম্ভব হবে না।
অন্যদিকে অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ (ইআরডি) সংশ্লিষ্টদের মতে, চীন সরকারের অর্থায়ন পকল্পে সে দেশের সরকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মনোনয়ন দিয়ে আসছে। মনোনয়ন পাওয়া পতিষ্ঠানই পকল্প ব্যয় ও নকশা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। ফলে তারা তাদের মতো করে ব্যয় নির্ধারণ করার সুযোগ পায়। কিন্তু একক প্রতিষ্ঠানের পরিবর্তে দরপত্রের মাধ্যমে একাধিক দরদাতা পতিষ্ঠান থেকে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যোগ্য পতিষ্ঠানকে বাছাই করার সুযোগ চেয়ে চীন সরকারের কাছে আবেদন করেছে ইআরডি। ওই বিষয়ে চীন বাংলাদেশকে আশ্বস্ত করেছে। তবে কেবল নতুন পকল্পের জন্য ওই নিয়ম কার্যকর করা হবে। যেসব পকল্পের ক্ষেত্রে ইতিমধ্যে বাণিজ্য চুক্তি হয়ে গেছে, সেসব প্রকল্পে ওই সুযোগ রাখা হবে না। এ অবস্থায় ওই পকল্পে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান নিয়োগ দেওয়া হবে না।
এদিকে এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের ভৌত অবকাঠামো বিভাগের প্রধান মো. এনায়েত হোসেন জানান, প্রকল্পের চূড়ান্ত অনুমোদন পেতে হলে রেলওয়েকে বাস্তবসম্মত ব্যয় নির্ধারণসহ কিছু শর্ত মানতে হবে। পিইসি সভায় ওসব শর্ত আরোপ করা হয়েছে। কেবল শর্তপূরণ করে ডিপিপি পুনর্গঠন করা হলেই প্রকল্পটি চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের (একনেক) সভায় উত্থাপন করা হবে।