পাকিস্তান জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে সাবেক ক্রিক্রেট অলরাউন্ডার ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পিটিআই আনুষ্ঠানিকভাবে বিজয়ী হয়েছে। এর আগে গতকাল বৃহস্পতিবার আনুষ্ঠানিক ফল আসার আগেই টেলিভিশনে জাতির উদ্দ্যেশ্যে ‘প্রধানমন্ত্রী স্টাইলে’ দেওয়া এক ভাষণে নিজেকে বিজয়ী দাবি করেন তিনি। সাধারণ মানুষকে দেন তার ভাষায় ‘নয়া পাকিস্তান’ গড়ার ওয়াদা।
বর্তমানে সর্বত্র সন্ত্রাসবাদের বিস্তার, আত্মঘাতী হামলায়, রাজনৈতিক নেতাদের দুর্নীতিতে পাকিস্তান অনেকটা ভঙ্গুর রাষ্ট্রের রুপ ধারণ করেছে। এমনকি অর্থনৈতিকভাবেও দেশটির অবস্থা শোচনীয়। এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে টিকে থাকতে হলে অবশ্যই ঘুরে দাঁড়াতে হবে। আর সদ্য বিজয়ী ইমরান খানের ভাষ্য থেকে সেই অবস্থা থেকে ঘুরে দাঁড়ানোরই একটি ইঙ্গিত প্রকাশিত হয়েছে।
ইমরান খান ভাষণের প্রথমেই দেশটিকে একটি মানবিক রাষ্ট্রে পরিণত করার কথা বলেছেন। এ ব্যাপারে তিনি উদাহরণ দিয়েছেন মানবতার মুক্তির দূত মোহাম্মদ (স) এর গড়া মদীনা রাষ্ট্রের কথা, যার ভিত্তিই ছিল মানবিকতা। বক্তব্যে তিনি দুর্বল, শোষিত ও পিছিয়ে পড়া শ্রেণিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন। সন্ত্রাস, দুর্নীতি ও দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে সর্বাত্মক সামর্থ্য দিয়ে কাজ করার কথা বলেছেন।
তবে ইমরান খান তার বক্তব্যে সবচেয়ে আশা জাগানিয়া যে কথাটি বলেছেন, যার চর্চা উপমহাদেশীয় রাজনীতিতে খুব একটা দেখা যায় না, সেটা হচ্ছে প্রতিদ্বন্দ্বী দলগুলোর প্রতি প্রতিহিংসাপরায়ণ মনোভাবের ইতি ঘটানো। তিনি বলেছেন, তিনি একটি ঐক্যবদ্ধ পাকিস্তান দেখতে চান। যারা তাকে ভোট দেয়নি বা নির্বাচনের আগে যারা তাকে ব্যক্তিগত আক্রমণ করেছেন তাদের সে আচরণকে তিনি ভুলে গিয়েছেন। তিনি রাজনৈতিক প্রতিহিংসামূলক কোনো পদক্ষেপ নেবেন না বলেও প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
পাশ্চাত্যের উদাহরণ দিয়ে বলেছেন, তিনি প্রত্যেকের জন্য আইনকে সমানভাবে প্রতিষ্ঠা করতে চান। দুর্নীতি ও রাষ্ট্রচালকদের ভোগ বিলাসের কারণে প্রবাসী পাকিস্তানিরা দেশের বিনিয়োগ করেন না বলে তিনি রাষ্ট্রের দুর্নীতি ও বেহুদা খরচ কমিয়ে ফেলার ঘোষণা দিয়েছেন। নাগরিকরাও ট্যাক্স প্রদান করে না একই কারণে, যা তিনি বন্ধ করে পাকিস্তানকে একটি ব্যবসাবান্ধব দেশে পরিণত করার ব্যবস্থা তার সরকার নেবে বলে জানিয়েছেন।
পররাষ্ট্র নীতির ব্যাপারেও পাকিস্তানকে তিনি অনেক উচ্চতায় নিয়ে যেতে চান। আফগানিস্তান, ইরান ও ভারতের সাথে তার উদারনীতি বাস্তবায়ন হবে বলে বক্তব্যে প্রকাশ পেয়েছে। আফগানিস্তান ভালো থাকলে পাকিস্তান ভালো থাকবে বলে তিনি মনে করেন। ভারতের সাথে কাশ্মির প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন আলোচনার মাধ্যমে সমঝোতায় পৌঁছাবেন। এক্ষেত্রে ভারত এক পা এগোলে তিনি দুই পা এগোনোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
এদিকে ভারতীয় কূটনৈতিকরা মিডিয়াগুলো ইমরান খানের সরকার ক্ষমতায় আসা প্রসঙ্গে ভীত হয়ে যেভাবে তাকে খল চরিত্ররূপে প্রকাশ করতে সচেষ্ট হয়েছে তাতে তিনি দুঃখবোধ করেছেন বলে জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারতের সাথে তার গভীর আত্মীয়তাবোধ রয়েছে। বক্তব্যে তিনি পাকিস্তানের ব্যাপারে সর্বদা সহযোগিতামূলক ভূমিকার জন্য চীন এবং সৌদি আরবের কথা স্মরণ করেন। একই সাথে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও তিনি পারস্পরিক লাভজনক সম্পর্ক গড়তে চান।
দুর্নীতি ও সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদের আখড়ায় নিমজ্জিত দেশটি সত্যিকার অর্থেই একটি শোচনীয় সময় পার করছে। ঠিক এই মুহূর্তে ইমরান খানের বিজয় এবং জাতির উদ্দেশে তিনি যে বক্তব্য প্রদান করেছেন তাতে সমস্যা সমাধানে তাকে যথেষ্ট পরিণত ও বিচক্ষণ বলে মনে করছেন বোদ্ধা মহল।
তবে পাকিস্তানের উন্নয়ন ও স্থিতিশীলতার ক্ষেত্রে সব সময়ই অন্তরায় হয়ে দেখা গেছে দেশটির সেনাবাহিনীর হস্তক্ষেপ ও প্রভাব খাটানো। বার বার সামরিক শাসনের কবলে পড়েছে দেশটি। এবারেও ইমরান খান যে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন তাতে যদি সামরিক বাহিনী অন্তরায় হয়ে না দাঁড়ায় তবে আশা করা যায় দেশটি একটি স্থিতিশীল ও সন্ত্রাসমুক্ত দেশে পরিণত হবে। এখন এই সব বিষয়ই দেখার অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় নেই বিশ্ববাসীর।