রংপুর এক্সপ্রেস: বিগত এক যুগের ব্যবধানে অনেকে পরিবর্তন হয়েছে উত্তরবঙ্গ। আগে পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও, নীলফামারী, দিনাজপুর কিংবা রংপুরের পতিত জমি-এক ফসলি আবাদের জমি ছিল অনেক বেশি। কিন্তু সাম্প্রতিক কালের চিত্র ভিন্ন এ অঞ্চলের। গত কয়েক বছরেই বদলে গেছে একসময়ের ‘মঙ্গাপীড়িত’ অঞ্চল হিসেবে খ্যাত এখানকার চাষাবাদ ও জীবনযাত্রার চিত্র। এখন অধিকাংশ জমিতে ধান ছাড়াও লিচু, আম, ভুট্টা, তরমুজ, বাদাম, বেগুন, শিম, বরবটিসহ নানা প্রকারের রবিশস্য আবাদ হচ্ছে। আর এখন রংপুরে তামাক চাষের বদলে চাষ হচ্ছে ভুট্টাসহ চার ফসলি আবাদ। তবে চা, কমলা, ভুট্টা ও বাদাম চাষে এখানকার কৃষকরা পেয়েছেন ব্যাপক সাফল্য। এদিকে কিছুদিন পূর্বে এ অঞ্চলে গড়ে উঠতে শুরু করেছে মাছ ও দুগ্ধ খামার, পোলট্রিশিল্প। এ অঞ্চলের শাক-সবজি এখন ছড়িয়ে পড়ছে সারাদেশে। এছাড়াও কুটিরশিল্প ছাড়াও ভারী শিল্পকারখানাও এখন দৃশ্যমান হচ্ছে এ অঞ্চলে। এক সংস্থার অনুযায়ী, ২০০৮ সালে উত্তরাঞ্চলের মানুষের গড় বার্ষিক পারিবারিক আয় ছিল ৩৫ হাজার টাকা। আর বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা। এ অগ্রগতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে মৌসুমি ফল ও ফসল।
২০০৮ সালে উত্তরাঞ্চলের মানুষের গড় বার্ষিক পারিবারিক আয় ছিল ৩৫ হাজার টাকা। আর বর্তমানে তা বেড়ে হয়েছে ৭৮ হাজার টাকা। এ অগ্রগতিতে সবচেয়ে বেশি অবদান রেখেছে মৌসুমি ফল ।’
বাড়ছে চা বাগান: উত্তরের তিন জেলা পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও ও দিনাজপুরে বেড়েছে চায়ের আবাদ। বোর্ডের আঞ্চলিক কার্যালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ তিন জেলায় দ্বিগুণ হারে বাড়ছে চা উৎপাদন। এ অঞ্চলে ১৬০০০ একর জমি চা চাষের উপযোগী। এর মধ্যে পঞ্চগড় ও ঠাকুরগাঁওয়ে ২ হাজার ২০০ হেক্টর জমির অন্তত ৮টি এস্টেট, ২০টি মাঝারি ও ৪২০টি নিবন্ধিত বাগান রয়েছে। এছাড়াও ক্ষুদ্র পরিসরে গড়ে উঠেছে প্রায় ৩ হাজার বাগান। ২০১৭ সালে জেলায় ১ কোটি ৪৫ লাখ ৭২ হাজার ৯৩৭ কেজি চা পাতা উৎপাদন হয়, যা প্রক্রিয়াকরণের পর দাড়ায় ৩২ লাখ ৬ হাজার ৪৬ কেজি।
দিনাজপুরের লিচু: সারা দেশে কমবেশি লিচু চাষ হলেও উত্তরাঞ্চলের দিনাজপুর জেলার লিচুর কদর আলাদা। প্রকৃতি ও আবহাওয়া অনুকূল থাকলে চলতি মৌসুমে লিচুর বাম্পার ফলনের সম্ভাবনা দিনাজপুরের লিচুর। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, গত মৌসুমে দিনাজপুরের ১৩টি উপজেলায় ৪ হাজার ১৮০ হেক্টর জমিতে লিচু চাষ হয়। উৎপাদিত হয় ২৫ হাজার টনের বেশি। আর লিচু চাষে অনেকেই ব্যাপক লাভবান হওয়ায় এ জেলাসহ আাশেপাশের জেলাগুলোতে দিন দিন লিচু চাষ বাড়ছে।
তামাকের বদলে ভুট্টা: তামাকের বদলে ভুট্টা চাষে অভূতপূর্ব উন্নয়ন ঘটেছে রংপুরের কৃষকদের। এ এলাকায় আগে যেসব মাঠে দেখা যেত তামাক ক্ষেত, এখন সেসব জায়গায় চোখে পড়ে ধান ক্ষেত। আর ত্রিফলা ছাড়িয়েও চার ফলা চাষাবাদ চলছে চোখে পড়ার মত। জানা গেছে, তামাকের আবাদ অনেকটাই কমে এসেছে এ অঞ্চলে। এ বছর মাত্র ৫ হাজার হেক্টর জমি হয়েছে তামাকের আবাদ। এর আগে গত বছরেও প্রায় ১০ হাজার হেক্টর জমিতে এ বিষবৃক্ষের চাষাবাদ হয়েছিলো। মূলত তামাক নিয়ন্ত্রনণে অন্যান্য চাষাবাদে সরকারের ভর্তুকি দেওয়ায় তামাক চাষে নিরুৎসাহিত হচ্ছেন কৃষকরা। শিগগিরই তামাক চাষ আরও কমে যাবে বলে জানাচ্ছেন স্থানীয় কৃষক। তামাকের বদলে ভুট্টা ও আলুর পাশাপাশি নানা ধরনের সবজি ও ত্রিফসলা ধানেই আগ্রহী হচ্ছেন তারা। এছাড়াও বিভিন্ন প্রজাতীর লাভজনক মাছ যেমন- শিং, মাগুর, সরপুঁটি, তেলাপিয়া, রুই, কই, কাতলা, কার্প প্রভৃতি মাছ চাষে আগ্রহ বেড়েছে কৃষকদের। এদিকে, নীলফামারীর ডিমলা উপজেলার তিস্তার চরগুলো এক সময়ে পড়ে থাকতো মরুভূমির মতো। এখন সেই বালির গ্রামটিও আর পতিত নেই। কৃষকরা গ্রামটিকে ভরে ফেলেছেন ভুট্টার আবাদে। সবুজে ভরা গ্রামটির কোন অংশ বাদ পড়েনি ভুট্টার আবাদ থেকে।
কমলা চাষ হচ্ছে পঞ্চগড়ে: পঞ্চগড় জেলার মাটি ও জলবায়ু কমলা চাষের জন্য অত্যন্ত উপযুক্ত। এখানে উৎপাদিক কমলা স্বাদে বা গন্ধে বাজারে আমদানীকৃত কমলার চেয়ে কোন অংশেই কম না। যে কারণে এ জেলার অনেক কৃষক এখন কমলা চাষে আগ্রহী হচ্ছেন। এছাড়াও ইতোমধ্যে কমলা চাষ করে লাভবান হয়েছেন অনেক চাষি। আর স্বল্প পরিশ্রম, ভালো ফলন ও মূল্য পাওয়ায় চাষিরা যেমন লাভবান হচ্ছেন তেমন দিন দিন বেড়েই চলেছে কমলা চাষের পরিধি। এদিকে জয়পুরহাটে কয়েকবছর থেকেই বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয়েছে মাল্টা চাষ। ইতোমধ্যে কৃষকরা আগ্রহী হচ্ছেন মাল্টা চাষে।
উত্তরের জেলাগুলোতে আগে যেসব পতিত জমি ছিল, স্থানীয়রা এসব জমিতে কোনো চাষাবাদই সম্ভব নয় বলে মনে করে গরু-ছাগল চারণ করতো। এখন সেসব জমিতে উৎপাদন হচ্ছে চা, আমন, বোরো ধানের শীষ। প্রযুক্তির ব্যবহার আর কৃষকের সচেতনতার কারণেই এখন এসব জমিতে উৎপাদন হচ্ছে নানা ধরনের ফসল। এসব ফসল মানুষ ভোগ করার পাশাপাশি ছড়িয়ে পড়ছে দেশের রাজধানী ঢাকাসহ অনেক জেলায়। একসময় রংপুর বিভাগের সাত জেলাকেই মানুষ চিনত ‘মঙ্গাপীড়িত’এলাকা হিসেবে। গত কয়েক বছরে পাল্টে গেছে সেই চিত্র। মঙ্গা তাড়াতে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ও ব্যক্তিপ্রতিষ্ঠান নানামুখী কর্মসূচি গ্রহণ করে। গড়ে ওঠা ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকারখানা আর কৃষিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনে বিপুলসংখ্যক বেকার জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে।
চলতি মৌসুমে ৩০ হাজার ১১৪ হেক্টর জমিতে ৯৭ হাজার ১৯৩ মেট্রিক টন টমেটো উৎপাদন করেছেন কৃষকরা। যার বেশির ভাগই হয়েছে পঞ্চগড় সদরে। এছাড়াও সদর উপজেলায় ভুট্টার আবাদ হয়েছে ১৭ হাজার ৭৫০ হেক্টর জমিতে । আর পুরো জেলায় হয়েছে ১ লাখ ৭৫ হাজার ৪২৬ মেট্রিক টন ভুট্টা উৎপাদন। জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের তথ্য বলছে, পঞ্চগড়ের বোদা উপজেলার অধিকাংশ কৃষক ভুট্টা চাষে বেশি আগ্রহী। তথ্য অনুযায়ী, দেশের চাহিদার অর্ধেক বাদাম উৎপাদন হয়েছে এ জেলায়। এ জেলায় বাদাম আবাদকৃত জমির পরিমাণ ১০ হাজার হেক্টর। যা থেকে উৎপাদিত হয় ১৯ হাজার ৯০০ মেট্রিক টন বাদাম। এছাড়াও উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন ঘটেছে কৃষকদের। এই অঞ্চলের মাটি ও আবহাওয়া কৃষির জন্য উপযোগী। এখানে প্রায় সব ধরনের ফসলের আবাদ করা হয়। আর নিজেদের চাহিদা পূরণে প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই রয়েছে আম, লিচু, কমলাসহ নানা ফল গাছ। সরিষা: আর সরিষা চাষে আগ্রহ দেখা গেছে দিনাজপুরে কৃষকদের। আগের বছর আশানুরূপ ফলন ও ভালো দাম পাওয়ায় গত মৌসুমে আরও বেশি জমিতে কৃষকরা চাষ করেন সরিষা। আর সরিষা থেকে মধু সংগ্রহও করেন অনেক কৃষক। সরিষা চাষে গত বছরে কৃষি বিভাগের লক্ষ্য ৮ হাজার হেক্টর হলেও তা লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে আবাদ হয় ১৩ হাজার হেক্টর জমিতে। দিনাজপুর ছাড়াও রংপুর, কুড়িগ্রাম, লালনিরহাটে গত মৌসুমে সরিষা চাষে ব্যাপক লাভবান হয়েছেন কৃষকরা। শুধু রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায় আড়াই’শ বিঘা জমিতে বারি সরিষা-১৪ চাষ করেন প্রায় দুশ’ কৃষক। আর কুড়িগ্রামের চিলমারীতে সরিষার আবাদ করে ব্যাপক লাভবান হন এ উপজেলার কৃষকেরা। উপজেলা কৃষি অফিসের তথ্য মতে, গত মৌসুমে ৩ শ' হেক্টর জমিতে সরিষা চাষ করা হয়।
বিগত কয়েক বছর থেকে একই জমিতে বছরে স্বল্পমেয়াদি পারিজা জাতের আমন ধান, সরিষা, আলু ও বারি জাতের মুগডালসহ ৪টি ফসল উৎপাদনের মাধ্যমে মঙ্গা নিরসন করেছে গাইবান্ধা জেলার কৃষকরা। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃক বাস্তবায়িত কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের সহযোগিতায় আরডিআরএস বাংলাদেশের উদ্যোগে ২০১৪ সাল থেকে গাইবান্ধায় একই জমিতে বছরে ৪টি ফসল- বিইউ-১, ব্রি-৫৬, ব্রি-৫৭, ধান, বারি মুগ-৬ ও পারিজা ধান চাষ করছেন কৃষকরা। শস্য নিবিড়তার ম্যাধ্যমে মঙ্গা নিরসন, কর্মসংস্থান ও খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করণে ব্যাপক ভূমিকা রাখছে এ জেলার কৃষকরা। এদিকে, যমুনা নদীর চরগুলোতে কৃষকরা ফসলের চাষ করেছেন। চরগুলো জেগে উঠলে কৃষকরা শুরু করেন চাষাবাদ। এ জমিগুলোতে একই সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষ করা সম্ভব হয়েছে। সমতলে ইরি-বোরো চাষসহ বালিমাটিতে চাষ করা হচ্ছে নানা ধরনের রবিশস্য। জানা যায়, কৃষকরা প্রথমে আঁখ চাষ করেন, পরে ওই জমিতেই লালশাক, পাট, কলমি শাক, আলু, রসুন, ভুট্রা চাষ করেন। অল্প সময়ে শাক-সবজি বিক্রি করে লাভবার হন চরাঞ্চলের কৃষকরা।
এদিকে চলমান মৌসুমে দেশের উত্তরাঞ্চলের চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও রাজশাহীর আম, দিনাজপুরের লিচু এবং যশোরের জাম আম, লিচু ও কাঁঠালসহ মৌসুমি ফলের বিপুল উৎপাদন সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। যে সময়ে এই রিপোর্ট লেখা হচ্ছে এই সময়ে এসব জেলায় হাজার হাজার কৃষক-চাষি বাগান পরিচর্যায় ব্যস্ত। অন্যদিকে ফলের ব্যবসাকে কেন্দ্র করে প্রস্তুত হচ্ছেন এসব ফলের মৌসুমী ব্যবসায়ীরা। পরিসংখ্যান বলছে, শুধু আমের রাজধানী খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জে প্রতি বছর লেনদেন হয় দেড় থেকে ২ হাজার কোটি টাকা। এ ছাড়া পঞ্চগড়, নাটোর, নওগাঁ, ঠাকুরগাঁও, পাবনা, দিনাজপুর ও রংপুরেও বাণিজ্যিকভাবে আম চাষ হচ্ছে অনেক বছর ধরেই। ব্যবসায়ীরা জানান, চলমান মৌসুমে আমের রাজধানী চাপাইয়ের পাঁচটি উপজেলায় ২৪ হাজার ৪৭০ হেক্টরেও বেশি জমিতে আম চাষ হয়েছে। কোন প্রাকৃতিক দুর্যোগ না ঘটলে জেলায় এবছর ২ লাখ ২০ হাজার টন আম উৎপাদিত হবে বলে জানান তারা। আর শুধু রাজশাহীতে প্রায় ১৬ হাজার ৬শ’ হেক্টর জমিতে আমের চাষ হচ্ছে। এতে ২ লাখ টনেরও বেশি আমের উৎপাদন হবে বলেও আশা করা হচ্ছে। এতে জেলা এবছর অন্তত ৪শ’ কোটি টাকার আম কেনাবেচা হওয়ার আশা করছেন ব্যবসায়ীরা।