ফিরে দেখা: রোহিঙ্গাদের সীমাহীন দুঃখ-দুর্দশার এক বছর

admin August 26, 2018

রংপুর এক্সপ্রেস ডেস্ক: এক বছর আগে মিয়ানমারের আরাকান রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা নিধনে অভিযান শুরু করে। জাতিগত নিধনের শিকার হয় কয়েক লাখ রেহিঙ্গা। জাতিগত নিধনের এই অভিযানে ২৪ হাজার রোহিঙ্গাকে হত্যা করা হয়। নির্যাতনের শিকার হয়ে প্রায় দেড় লাখ রোহিঙ্গা এবং ১৫ হাজার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়। প্রাণ বাঁচাতে লাখ লাখ রোহিঙ্গা বসতভিটা ছেড়ে সীমান্ত পাড়ি বাংলাদেশের টেকনাফে পালিয়ে আসে। মানবিক কারণে বাংলাদেশ তাদের আশ্রয় দেয়।


গত একবছর ধরে রোহিঙ্গাদের ওপর অত্যাচার এবং বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গা শরণার্থীদের উল্লেখযোগ্য ঘটনাবলীতে চোখ রাখা যাক।


২৪ আগস্ট ২০১৭: রোহিঙ্গাদের একটি সংগঠন 'আরাকান রোহিঙ্গা সালভেশন আর্মি' (আরসা) মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশের ওপর হামলা চালায় বলে অভিযোগ করে মিয়ানমার। সে হামলায় মিয়ানমার বর্ডার গার্ড পুলিশের ১২ জন সদস্য নিহত হয় বলে দাবি করেছিল দেশটি। মিয়ানমার সরকার দাবি করেছে যে, ভোররাতে একযোগে ২০টির বেশি পুলিশ ক্যাম্পে হামলা চালানো হয়। উত্তর রাখাইন অঞ্চলে এসব হামলার ঘটনা ঘটে।


২৫ আগস্ট ২০১৭: রোহিঙ্গাদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন শুরু হয়। কয়েক হাজার রোহিঙ্গা কক্সবাজারের উখিয়া এবং টেকনাফে এসে আশ্রয় নেয়। তারা মিয়ানমার সেনাবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের বিবরণ দেয় বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমকে।


২৬ আগস্ট ২০১৭: রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসার পরিপ্রেক্ষিতে ঢাকায় নিযুক্ত মিয়ানমারের দূতকে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে ডেকে উদ্বেগ জানানো হয়। একই দিন বাংলাদেশের ভূখণ্ডে ঢোকার চেষ্টা করায় বেশকিছু রোহিঙ্গাকে আটক করে বিজিবি। সে সময় হাজার-হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশ আশ্রয় নেয়ার জন্য সীমান্তের অপর পাশে অপেক্ষা করতে থাকে।


৩১ আগস্ট ২০১৭: এক সপ্তাহের মধ্যে প্রায় ২৭ হাজার রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসে। এ তথ্য দিয়েছে জাতিসংঘের কর্মকর্তারা।


৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭: মিয়ানমারবিষয়ক জাতিসংঘের বিশেষ দূত ইয়াংহি লি রাখাইনের পরিস্থিতিকে ‘ভয়াবহ' হিসেবে বর্ণনা করেন। মিস লি মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চির সমালোচনা করেন।


৫ সেপ্টেম্বর ২০১৭: রাখাইন অঞ্চলের পরিস্থিতিকে বিকৃতভাবে তুলে ধরা হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন মিয়ানমারের নেত্রী অং সান সু চি। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যিপ এরদোগানের সঙ্গে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি নিয়ে টেলিফোনে আলোচনার পর মিস সু চির দফতর থেকে এক বিবৃতিতে এ কথা জানানো হয়। একই দিন রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনার জন্য ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদি ঢাকায় আসেন। তার আগে তিনি মিয়ানমার সফর করেছেন।


৬ সেপ্টেম্বর ২০১৭: রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদকে চিঠি লিখেছেন মহাসচিব অ্যান্তনিও গুতেরেস।


৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭: বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে তুরস্কের ফার্স্ট লেডি এবং পররাষ্ট্রমন্ত্রী কক্সবাজারের উখিয়ায় যান।


১১ সেপ্টেম্বর ২০১৭: জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক সংস্থা রোহিঙ্গাদের ওপর নিপীড়নকে জাতিসংঘ জাতিগত নিধনের উদাহরণ হিসেবে বর্ণনা করে।


১২ সেপ্টেম্বর ২০১৭: রোহিঙ্গা পরিস্থিতি দেখতে কক্সবাজারের উখিয়ায় যান বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। সেখানে গিয়ে তিনি রোহিঙ্গা সংকট মোকাবেলায় সরকারের সর্বাত্মক উদ্যোগের কথা কথা জানান। মানবিক বিবেচনায় সরকার রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দিয়েছে বলে উল্লেখ করেন শেখ হাসিনা।


১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৭: মিয়ানমার থেকে প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের দেখতে ঢাকায় কর্মরত প্রায় অর্ধশত বিদেশি কূটনীতিক ও বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিরা কক্সবাজার সফর করেন। রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিয়ানমারের ওপর চাপ তৈরির যে চেষ্টা বাংলাদেশ শুরু করেছে তারই অংশ হিসেবে বিদেশি কূটনীতিকদের বিশাল এই দলটিকে কক্সবাজার নিয়ে যায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।সকালে একটি বিশেষ বিমানে করে তাদের নেয়া হয় কক্সবাজারে।যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, রাশিয়া, চীন, ভারত, সৌদি আরবের রাষ্ট্রদূতরা এই সফরে শামিল হয়েছিলেন।


২১ সেপ্টেম্বর ২০১৭: বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি রোহিঙ্গা সংকট তুলে ধরে সেটি সমাধানের জন্য পাঁচ দফা সুপারিশ উত্থাপন করেন। শেখ হাসিনার উত্থাপিত বিষয়গুলোর মধ্যে ছিল – রোহিঙ্গাদের ওপর হত্যাযজ্ঞ বন্ধ করা, মিয়ানমারে তাদের প্রত্যাবাসন নিশ্চিত করা এবং জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে রাখাইনে নিরাপদ অঞ্চল গড়ে তোলা।


২৭ সেপ্টেম্বর ২০১৭: জাতিসংঘের অভিবাসনবিষয়ক সংস্থা আইওএম-এর হিসাব অনুযায়ী বাংলাদেশে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের সংখ্যা পাঁচ লাখ ছাড়িয়েছে। সংকট শুরু হওয়ার ৩৪ দিনের মধ্যেই বাংলাদেশে পাঁচ লাখ রোহিঙ্গা আশ্রয় নিয়েছে।


২৯ সেপ্টেম্বর ২০১৭: দীর্ঘ আট বছর পর জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন এবং ফ্রান্সের উদ্যোগে এ বৈঠকের আহ্বান করা হয়েছিল। সে বৈঠকে জাতিসংঘে মার্কিন রাষ্ট্রদূত নিকি হেলি মিয়ানমারের সমালোচনা করেন।


৬ নভেম্বর ২০১৭: জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদ রোহিঙ্গা সংকটের অবসান চেয়ে একটি বিবৃতি দিয়েছে। যেখানে মিয়ানমার সরকারের প্রতি রাখাইনে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীর ওপর নৃশংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধের জোরালো দাবি তোলা হয়েছে। এই বিবৃতিতে চীনেরও সম্মতি আদায় করা গেছে।রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ থেকে প্রথম বারের মতো কোনো বিবৃতি এল।


১৮ নভেম্বর ২০১৭: চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই ঢাকা সফরে আসেন। ঢাকায় তিনি বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলীর সঙ্গে রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে কথা বলেন। মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের ওপর জোর দিয়েছেন চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী।


২৩ নভেম্বর ২০১৭: রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নেয়ার বিষয়ে মিয়ানমারের রাজধানী নেপিডোতে বাংলাদেশ এবং মিয়ানমারের মধ্যে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে। সেখানে বলা হয়েছে যে রোহিঙ্গাদের পরিচয় যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে নিশ্চিত হয়ে মিয়ানমারে ফেরত নেয়া হবে। সেখানে সিদ্ধান্ত হয় বাংলাদেশ থেকে প্রতিদিন ৩০০ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত নেবে।যেদিন থেকে যাওয়া শুরু হবে, তার পরবর্তী দুই বছরের মধ্যে প্রক্রিয়াটি শেষ হবে বলে বাংলাদেশের কর্মকর্তারা বলছেন।


৩০ নভেম্বর ২০১৭: তিন দিনের সফরে ঢাকায় আসেন রোমান ক্যাথলিকদের ধর্মগুরু পোপ ফ্রান্সিস। এরপর দিন অর্থাৎ ১ ডিসেম্বর ঢাকার কাকরাইলে বাংলাদেশে খ্রিস্টানদের প্রধান গির্জায় তিনি কয়েকজন রোহিঙ্গার সঙ্গে কথা বলেন। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা এবং বাংলাদেশ সরকারের ব্যবস্থাপনায় ক্যাম্প থেকে বাছাই করা রোহিঙ্গাদের ঢাকায় আনা হয়। সে অনুষ্ঠানে পোপ ফ্রান্সিস প্রথমবারের মতো ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি উচ্চারণ করেন। যদিও এর আগে তার মিয়ানমার সফরের সময় পোপ ফ্রান্সিস ‘রোহিঙ্গা' শব্দটি উচ্চারণ করেননি।


১৬ ফেব্রুয়ারি ২০১৮: বাংলাদেশ সরকার মিয়ানমারে ফেরত পাঠানোর জন্যে ৮ হাজার রোহিঙ্গার একটি তালিকা বার্মার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর হাতে তুলে দিয়েছে। ঢাকায় দু'দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে এই তালিকা হস্তান্তর করা হয়। পরবর্তীতে সে তালিকা থেকে মাত্র ৩৭৪ জনকে নিতে রাজি হয় মিয়ানমার।


২৯ এপ্রিল ২০১৮: রোহিঙ্গাদের দুর্দশা স্বচক্ষে দেখার জন্য জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের একটি দল রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেছে। বাংলাদেশ ছেড়ে যাওয়ার আগে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের দলটি আবারো বলেছে, রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধান হবে না।এ সফরের সময় রাশিয়ার প্রতিনিধি বলেছেন রোহিঙ্গা সংকটের কোন জাদুকরি সমাধান নেই। নিরাপত্তা পরিষদের পাঁচটি স্থায়ী এবং ১০টি অস্থায়ী সদস্য দেশের প্রতিনিধিরা এ দলে অন্তর্ভুক্ত ছিলেন।


২ জুলাই ২০১৮: রোহিঙ্গাদের দুর্দশা দেখার জন্য জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেস এবং বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্টের জিম ইয়ং কিম একসঙ্গে রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলার পর জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন, " রোহিঙ্গারা বিচার চায়। নিরাপদে বাড়ি ফিরতে চায়।" এক সংবাদ সম্মেলনে আন্তোনিও গুতেরেস বলেছেন, রোহিঙ্গাদের যে দুঃখ-কষ্ট তিনি দেখেছেন তাতে তার হৃদয় ভেঙে গেছে।

এই বিভাগের আরও খবর

পরবর্তী পোস্ট
« Prev Post
পূর্বের পোস্ট
Next Post »
নিচের বক্সে মন্তব্য লিখুন

Disqus
আপনার মন্তব্য যোগ করুন

No comments

Image Gallary

 
1 / 3
   
Caption Text
 
2 / 3
   
Caption Two
 
3 / 3
   
Caption Three