ফেনীর নুসরাত হত্যাকাণ্ড: মামলার চার্জশিটে হত্যার বর্ণনা

admin May 29, 2019

রংপুর এক্সপ্রেস ডেস্ক:
ফেনীর সোনাগাজীর বহুল আলোচিত মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফি হত্যা মামলার চার্জশিট দাখিল করা হবে ২৯ মে, বুধবার। চার্জশিটে ১৬ জনকে আসামি করা হয়েছে। তাদের সবার বিরুদ্ধেই সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ডের দাবি জানানো হয়েছে। ২৮ মে, মঙ্গলবার সকালে রাজধানীর ধানমণ্ডিতে পিবিআই সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানায় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই)।


আদালতে ১২ জন আসামির দেওয়া জবানবন্দী ও ৯২ জন সাক্ষীর সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে ফেনীর মাদরাসাছাত্রী নুসরাত জাহান রাফিকে পুড়িয়ে হত্যার পূর্ণাঙ্গ চার্জ শিট দিচ্ছে পিবিআই। যেখানে এ হত্যার ঘটনায় মোট ১৬ জনকে আসামি করে আদালতে জমা দেওয়ার জন্য অভিযোগপত্র চূড়ান্ত করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলাকে হত্যার হুকুমদাতা হিসেবে আসামি করা হয়েছে এবং ১৬ জন আসামির প্রত্যেকের মৃত্যুদণ্ড চাওয়া হয়েছে।


অভিযোপত্রে উল্লেখ থাকা আসামিরা হলেন- এস এম সিরাজ উদ দৌলা (৫৭), নুর উদ্দিন (২০), শাহাদাত হোসেন শামীম (২০), মাকসুদ আলম ওরফে মোকসুদ কাউন্সিলর (৫০), সাইফুর রহমান মোহাম্মদ জোবায়ের (২১), জাবেদ হোসেন ওরফে সাখাওয়াত হোসেন (১৯), হাফেজ আব্দুল কাদের (২৫), আবছার উদ্দিন (৩৩), কামরুন নাহার মনি (১৯), উম্মে সুলতানা ওরফে পপি ওরফে তুহিন ওরফে চম্পা/শম্পা (১৯), আব্দুর রহিম শরীফ (২০), ইফতেখার উদ্দিন রানা (২২), ইমরান হোসেন ওরফে মামুন (২২), মোহাম্মদ শামীম (২০), রুহুল আমিন (৫৫) এবং মহিউদ্দিন শাকিল (২০)।


চার্জশিট অনুযায়ী, ১৬ জন আসামি পাঁচটি দলে ভাগ হয়ে নুসরাত হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়। এদের মধ্যে দলনেতা নির্দেশনা প্রদান করে জেল থেকে এবং সহায়তা ও কর্মপরিকল্পনা সম্পন্ন করে আওয়ামী লীগ নেতা, শিক্ষার্থীসহ বাকি ১৫ জন। এই পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে হত্যাকারীরা সময় নেয় ৩ দিন।


সংবাদ সম্মেলনে পিবিআই প্রধান ও পুলিশের উপ-মহাপরিদর্শক (ডিআইজি) বনজ কুমার মজুমদার বলেন, “গত ২৭ মার্চ সকালে অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলা ওই মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার্থী নুসরাত জাহান রাফিকে তার কক্ষে ডেকে নিয়ে শ্লীলতাহানির চেষ্টা করেন। এ ঘটনায় নুসরাতের মা শিরিন আক্তার সোনাগাজী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে একটি মামলা করেন। পুলিশ ওই দিনই মাদ্রাসার অধ্যক্ষকে গ্রেপ্তার করে আদালতের মাধ্যমে তাকে জেলহাজতে পাঠানো হয়।”


“এরপর অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার মুক্তি দাবিতে ‘মুক্তি পরিষদ’ নামে একটি কমিটি গঠন করা হয়। এ কমিটির আহ্বায়ক নুর উদ্দিন এবং যুগ্ম আহ্বায়ক হন শাহাদাত হোসেন শামীম। তাদের নেতৃত্বে অধ্যক্ষের মুক্তির দাবিতে গত ২৮ ও ৩০ মার্চ উপজেলা সদরে দুই দফা মানববন্ধন ও বিক্ষোভ কর্মসূচি পালিত হয়।”


পিবিআই প্রধান বলেন, “অপরদিকে নুসরাতকে শ্লীলতাহানি চেষ্টা করায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিচারের দাবিতে গত ২৮ মার্চ মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের একাংশ মানববন্ধন করলে নুর উদ্দিন ও শাহাদাত হোসেন শামীম তাদেরকে দেখে নেওয়ার হুমকি দেন। এছাড়াও, মাদ্রাসার আইসিটি পরীক্ষার ভাইভাতে সবাইকে ফেল করানোরও হুমকি দেওয়া হয়। এতে শিক্ষার্থীরা ভয় পেয়ে আর কোনো প্রতিবাদ জানায়নি।”


পিবিআই থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উঠে আসা নুসরাত হত্যার বর্ণনায় বলা হয়, ‘মাদ্রাসার অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার বিরুদ্ধে নুসরাত জাহান রাফির করা অভিযোগ ও মামলায় সিরাজ উদ দৌলা গ্রেপ্তার হলে তার অনুগত লোকজন ক্ষিপ্ত হয়। গত ১ এপ্রিল আসামী শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, ইমরান, হাফেজ আব্দুল কাদের ও রানা আসামি সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে জেলখানায় দেখা করে। সেখানে সিরাজ উদ দৌলা তার মুক্তির বিষয়ে জোর প্রচেষ্টা চালাতে ও মামলা তুলে নিতে নুসরাতের পরিবারকে চাপ দিতে নির্দেশনা দেয়।


হুমকি ও ভয়ভীতি প্রদর্শনের পরও মামলা তুলে না নিলে আসামিরা নুসরাতের ওপর ক্ষুব্ধ হয়। এছাড়া আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম নুসরাতকে প্রেমের প্রস্তাব দিয়ে প্রত্যাখ্যাত হয়ে ক্ষুব্ধ ছিলো। ফলশ্রুতিতে শাহাদাত হোসেন শামীম, কাউন্সিলর মাকসুদ ও রুহুল আমিনের সঙ্গে আলোচনা করে নুসরাত জাহান রাফিকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে যেকোনো কিছু করার পরিকল্পনা করে।


পিবিআই’র তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, কাউন্সিলর মাকসুদ এ কাজে শাহাদাত হোসেনকে ১০ হাজার টাকা প্রদান করে। উক্ত টাকা দিয়ে শাহাদাত হোসেন শামীম পরিকল্পনা মোতাবেক তার দূর সম্পর্কের ভাগ্নি কামরুন্নাহার মনিকে দিয়ে দুইটি বোরখা ও ৪ জোড়া হাতমোজা কেনায়। পরবর্তীতে ৩ এপ্রিল আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, হাফেজ আব্দুল কাদেরসহ কয়েকজনকে নিয়ে জেলখানায় অধ্যক্ষ সিরাজ উদ দৌলার সঙ্গে দেখা করে। সেখানে সিরাজ উদ দৌলা তাদের নুসরাতকে ভয়ভীতি দেখানো ও প্রয়োজনে পুড়িয়ে হত্যার নির্দেশ প্রদান করে এবং হত্যাকাণ্ডের পর ঘটনাটি আত্মহত্যা বলে চালিয়ে দেওয়ার নির্দেশ দেন।


৪ এপ্রিল পরিকল্পনা মোতাবেক বিকাল আনুমানিক ৩ টায় মাদ্রাসার পাশের টিনশেড কক্ষে আসামী শাহাদাত হোসেন শামীম, নুর উদ্দিন, জোবায়ের, জাবেদ, পপি ও কামরুন্নাহারসহ আরও কয়েকজন মিটিং করে এবং নুসরাতকে হত্যার পরিকল্পনা করে। একই দিন রাত সাড়ে ৯টায় পুনরায় মাদ্রাসার ছাত্র হোস্টেলে নুসরাত হত্যার পরিকল্পনা নিয়ে আলোচনা হয়। পরিকল্পনা অনুযায়ী ৫ এপ্রিল বিকাল ৫টায় ভূঁইয়া বাজার থেকে আসামি শাহাদাত হোসেন শামীম ১ লিটার কেরোসিন তেল কিনে নিজের কাছে রেখে দেয়।


৬ এপ্রিল সকাল ৭টার দিকে শামীম, নুর, কাদের মাদরাসা প্রাঙ্গণে আসে এবং পরিকল্পনা অনুযায়ী ৮টা থেকে ৯টা ২০ মিনিটের মধ্যে আসামিরা যার যার অবস্থানে চলে যায়। শামীম পলিথিনে করে নিয়ে আসা কেরোসিন তেল ও অধ্যক্ষের কক্ষের সামনে থেকে একটি কাঁচের গ্লাস নিয়ে ছাদের বাথরুমের পাশে রেখে দেয়। মনির কেনা দুটি ও বাড়ি থেকে নিয়ে আসা একটি মোট ৩টি বোরখা ও ৪ জোড়া হাতমোজা নিয়ে সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় রাখে। শামীম, জাবেদ ও জোবায়ের সাড়ে ৯টার দিকে বোরখা ও হাত মোজা পরিধান করে তৃতীয় তলায় অবস্থান করে।


নুসরাত পরীক্ষা দিতে আসলে পরিকল্পনা অনুযায়ী পূর্বে অবস্থান করা উম্মে সুলতানা পপি নুসরাতকে তার বান্ধবীকে মারধরের কথা বলে। নুসরাত দৌড়ে ছাদে যেতে থাকে। নুসরাত দ্বিতীয় তলায় পৌঁছালে পপি নুসরাতকে হুজুরের বিরুদ্ধে মামলা তুলে নিতে বলে ও ভয় দেখায়। নুসরাত মামলা তুলবে না বলতে বলতে পপির সাথে ছাদে উঠলে মনি, শামীম, জোবায়ের ও জাবেদ নুসরাতের পিছনে ছাদে যায়। ছাদে তারা নুসরাতকে মামলা তুলে নিতে হুমকি প্রদান করে কয়েকটি কাগজে স্বাক্ষর দিতে বলে।


নুসরাত স্বাক্ষর দিতে অস্বীকৃতি জানালে আসামিরা ক্ষিপ্ত হয়। শামীম বাম হাত দিয়ে নুসরাতের মুখ চেপে ধরে এবং ডান হাত দিয়ে নুসরাতের হাত পিছন দিকে নিয়ে আসে। পপি নুসরাতের গায়ের ওড়না খুলে জোবায়েরকে দিলে জোবায়ের ওড়না দু’ভাগ করে ফেলে। ওড়নার এক অংশ দিয়ে পপি ও মনি নুসরাতের হাত পিছনে বেধে ফেলে, অন্য অংশ দিয়ে জোবায়ের নুসরাতের পা পেঁচিয়ে ফেলে। জাবেদ পায়ে গিঁট দেয়। সকলে মিলে নুসরাতকে ছাদের ফ্লোরে ফেলে দিলে শাহাদাত নুসরাতের মুখ ও গলা চেপে রাখে।


মনি নুসরাতের বুকের ওপর চাপ দিয়ে ধরে এবং পপি ও জোবায়ের পা চেপে ধরে। জাবেদ পাশের বাথরুমে লুকানো কেরোসিনের পলিথিন থেকে কাচের গ্লাসে কেরোসিন নিয়ে নুসরাতের পুরো গায়ে ঢেলে দেয়। শামীমের ইশারায় জোবায়ের ম্যাচ দিয়ে নুসরাতের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়। আগুন ধরিয়ে প্রথমে জোবায়ের ছাদ থেকে নামে, এরপর পপি ছাদ থেকে নেমে যেতে থাকে। ওই সময় পূর্বের শিখানো মতে মনি; পপিকে ‘কাম কাম চম্পা/শম্পা’ বলে ডেকে নিচে নেমে যায়। মনি ও পপি নিচে নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে যায়। জাবেদ ও শামীম সাইক্লোন সেন্টারের তৃতীয় তলায় গিয়ে বোরখা খুলে ফেলে। জাবেদ শাহাদাতকে তার বোরখা দিয়ে দ্রুত নেমে পরীক্ষার হলে ঢুকে। শামীম নেমে মাদরাসার বাথরুমের পাশ দিয়ে চলে যায় ও মাদরাসার পুকুরে বোরখা ফেলে দেয়। জোবায়ের সাইক্লোন সেন্টার থেকে নেমে মাদরাসার মূল গেট দিয়ে বের হয়ে যায় এবং বোরখা ও হাতমোজা সোনাগাজী কলেজের ডাঙ্গি খালে ফেলে দেয়। নুর সাইক্লোন সেন্টারের নিচে থেকে পুরো ঘটনার তদারকির দায়িত্ব পালন করে।


পিবিআই প্রতিবেদনে বলা হয়, এছাড়া আসামি মহিউদ্দীন শাকিল ও মোহাম্মদ শামীম সাইক্লোন সেন্টারের দুই সিঁড়ির সামনে পাহারারত থাকে। মাদরাসার মূল গেইটের পাশে ইফতেখার উদ্দিন রানা, ইমরান হোসেন মামুন, আব্দুর রহিম শরীফ ও হাফেজ আব্দুল কাদের পাহারারত থাকে। হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করার পর আসামিরা নিরাপদ স্থানে সরে গিয়ে ঘটনাটিকে আত্মহত্যা বলে বিভিন্নভাবে প্রচারণা চালায়।


নুসরাত অগ্নিদগ্ধ অবস্থায় নিচে নেমে আসতে থাকলে কর্তব্যরত পুলিশ কনস্টেবল ও নাইটগার্ড আগুন নেভায়। ওই সময় নুরও নুসরাতের গায়ে পানি দেয় এবং কাদের নুসরাতের ভাই নোমানকে ফোনে সংবাদ দেয়। পরবর্তীতে নুসরাতকে হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য নেওয়া হয়। নুসরাত জাহান রাফি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুকালীন জবানবন্দী প্রদান করে। উক্ত জবানবন্দীতে তাকে অগ্নিদগ্ধ করার ঘটনাটি একইভাবে বর্ণিত হয়েছে।


গত ৬ এপ্রিল সকালে আলিম পরীক্ষা দিতে সোনাগাজী ইসলামিয়া সিনিয়র ফাজিল মাদ্রাসায় যান নুসরাত জাহান রাফি। বোরকা পরিহিত কয়েকজন কৌশলে তাকে ছাদে ডেকে নিয়ে অধ্যক্ষের বিরুদ্ধে করা শ্লীলতাহানির মামলা তুলে নিতে চাপ দেয়। অস্বীকৃতি জানালে তার গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়। এ ঘটনায় অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলা, পৌর কাউন্সিলর মাকসুদ আলমসহ আটজনের নাম উল্লেখ করে সোনাগাজী মডেল থানায় মামলা করেন রাফির বড়ভাই মাহমুদুল হাসান নোমান।


১০ এপ্রিল রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে মারা যান অগ্নিদগ্ধ রাফি। এর আগে ২৭ মার্চ রাফিকে নিজ কক্ষে নিয়ে যৌন নিপীড়নের অভিযোগে অধ্যক্ষ সিরাজউদ্দৌলাকে গ্রেফতার করে পুলিশ। পর দিন তাকে কারাগারে পাঠানো হয়। পরে তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। এ পর্যন্ত রাফি হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার ২২ জনের মধ্যে সিরাজউদ্দৌলাসহ ১২ জন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

এই বিভাগের আরও খবর

পরবর্তী পোস্ট
« Prev Post
পূর্বের পোস্ট
Next Post »
নিচের বক্সে মন্তব্য লিখুন

Disqus
আপনার মন্তব্য যোগ করুন

No comments

Image Gallary

 
1 / 3
   
Caption Text
 
2 / 3
   
Caption Two
 
3 / 3
   
Caption Three