রংপুর: রংপুরের সড়ক-মহাসড়কগুলোতে ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে অবৈধ ট্রলি-ট্রাক্টরের চলাচল। সড়কে এসব যানের উপস্থিতি গণমানুষের স্বাভাবিক চলাফেরায় বিঘ্ন ঘটাচ্ছে। সড়কে চলাচলের জন্য এসব পরিবহনের কোনো রুট পারমিট না থাকলেও দাপিয়ে বেড়াচ্ছে তারা। কিন্তু চোখের সামনে অবৈধ এসব যানের অবাধ চলাচল লক্ষ্য করেও কার্যকর কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করছে না সংশ্লিষ্ট প্রশাসন। অভিযোগ রয়েছে, অবৈধ এসকল ট্রলি-ট্রাক্টরের মালিকের কাছে মাসোহারা আদায়ের কারণেই এদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থা নেয়া হয় না। ফলে প্রতিনিয়ত ঘটছে দুর্ঘটনা।
জানা গিয়েছে, কৃষি কাজের জন্য ভুর্তুকি দিয়ে বিদেশ থেকে ট্রাক্টর আমদানি করা হয়। আমদানিকারকরা এসব ট্রাক্টর বিক্রি করে ইটভাটার মালিক, মাটি ও বালু ব্যবসায়ী, কাঠ ব্যবসায়ী ও শিল্প মালিকসহ সাধারণ পরিবহন ব্যবসায়ীদের কাছে। ব্যবসায়ীরা ট্রাক্টরের পিছনে ট্রলির বডি লাগিয়ে মহাসড়কে মালামাল পরিবহনের কাজে ব্যবহার করছে।
রংপুর জেলায় অবৈধ এসব ট্রলি-ট্রাক্টরের সংখ্যা কত, সে বিষয়ে জেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট কারও কাছে কোনো তথ্য নেই। তবে জেলাজুড়ে হাজার হাজার ট্রলি-ট্রাক্টর হাইওয়ে থেকে শুরু করে গ্রামের রাস্তাগুলোতে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) রংপুরের সহকারী পরিচালক আব্দুল কুদ্দুস বলেন, ট্রাক্টর মাঠে কৃষিকাজের জন্য অনুমোদিত, সড়ক-মহাসড়কে চলাচল কিংবা পণ্য সামগ্রী বহনের অনুমতি নেই। সম্পূর্ণ বে-আইনিভাবে এ যানটি সড়কে চলাচল করছে।
স¤প্রতি নগরীর টার্মিনাল, মডার্ণ মোড়, চেকপোস্টসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, চলাচলকারী মালবোঝাই ট্রাক্টরের কোনোটিরই লাইসেন্স নেই। এ ছাড়া ট্রাক্টরের কোনো নম্বর-প্লেটও নেই। কোনো কোনো ট্রাক্টর ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েক গুণ বেশি মালামাল বোঝাই করে বেপরোয়া গতিতে চলাচল করছে। চালকেরও নেই ড্রাইভিং লাইসেন্স।
[এক মডেলের ‘লিভ টুগেদার’ ও তিন নিষ্পাপ শিশুর এতিম হওয়ার গল্প]
টার্মিনাল এলাকার ট্রাক্টর চালক সুজা মিয়া জানায়, তৃতীয় শ্রেণি পাস করে সে বেকার ছিলো। গত দুই বছর ধরে ট্রাক্টর চালাচ্ছে। ড্রাইভিং লাইসেন্স করার বিষয়টি তার জানা নেই। রাস্তায় পুলিশ ধরলে মালিকের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলে দিতে হয়। পরে তারা ট্রাক্টর ছেড়ে দেয়। ব্যস্ত সড়কের মধ্যে দ্রুত ট্রাক্টর চালানোর বিষয়ে জানতে চাইলে বালুবাহী ট্রাক্টরের চালক সাইফুল ইসলাম বলেন, খদ্দেরের চাহিদা অনুযায়ী দ‚র থেকে বালু আনতে হয়। কম সময়ের মধ্যে যত বেশি বালু আনতে পারব, ততই আমার লাভ। তাই একটু দ্রুত চালিয়ে যেতে হয়।
নগরীর কেরানীপাড়া এলাকার খোরশেদুল আলম জানান, ট্র্রাক্টরগুলো অদক্ষ চালকদের হাতে থাকায় তাঁরা প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটাচ্ছে। সম্প্রতি পিটিসি’র মোড়ে একটি আটোরিকশার ওপর ট্রাক্টর উঠে গেলে তিনজন গুরুতর আহত হন। এছাড়া আমার চোখের সামনে এর আগেও অনেকবার দুর্ঘটনা ঘটেছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক ট্রাক্টর মালিক জানান, প্রতিটি ট্রাক্টরের জন্য ১ থেকে ২ হাজার টাকা হারে পুলিশকে মাসোহারা দিতে হয়। হাইওয়ে ও ট্রাফিক পুলিশের লোক নির্ধারিত স্থান থেকে এ মাসোহারা আদায় করেন। প্রতি মাসের ৫ তারিখের মধ্যেই এ মাসোহারা আদায় করা হয়। কোনো ট্রাক্টর মালিক যদি মাসোহারা দিতে কালক্ষেপন করেন কিংবা মাসোহারা দিতে অস্বীকৃতি জানান তাহলে তার ট্রাক্টর আটকে রেখে জরিমানাসহ বিভিন্ন হয়রানি করা হয়।খোঁজ নিয়ে জানা যায়, রংপুর সদর এলাকাসহ জেলায় যে সকল ট্রাক্টর চলাচল করে তার প্রত্যেকটির জন্য মালিকের কাছ থেকে ১/২ হাজার টাকা মাসোহারা আদায় করা হয়। যে সকল ট্রাক্টর মালিক মাসোহারা দেন না, বিভিন্ন সময় অভিযান পরিচালনা করে তাদের ট্রাক্টর আটক করে জড়িমানা করা হয়। শুধু তাই নয়, সড়কে যে সকল ফিটনেস বিহীন ট্রাক চলাচল করে তাদের কাছ থেকেও প্রকারভেদে দেড় থেকে ৩ হাজার টাকা পর্যন্ত মাসোহারা আদায় করা হয়। যারা মাসোহারা দিতে অস্বীকৃতি জানায় তাদের বিভিন্নভাবে হয়রানি করা হয়।
তবে মাসোহারা আদায়ের বিষয়টি অস্বীকার করে রংপুর জেলা ট্রাফিক পুলিশের ইনচার্জ খান মো. মিজানুর ফাহিমী বলেন, লোকে এ ধরনের অনেক অভিযোগ করে। আসলে এ ধরণের অভিযোগের কোনো ভিত্তি নেই। তিনি আরো বলেন, সড়ক নিরাপত্তার জন্য এসব অবৈধ যানের চলাচল প্রতিরোধে আমরা কাজ করছি। বিভিন্ন স্থানে মোবাইল কোর্ট পরিচালনা করছি। যারা ধরা পড়ছেন তাদের যান আটকে রাখা ও জরিমানা করাসহ প্রয়োজনী আইনি ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, এ ধরনের সংবাদ লিখে কোন লাভ নেই। বড়দরগা হাইওয়ে পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, অবৈধ এ যানের চলাচল প্রতিরোধে প্রতিদিনই বিভিন্ন স্থানে অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে। যারা ধরা পড়ছেন তাদের বিরুদ্ধে জরিমানা ও মামলা করাসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
রংপুরের পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান বলেন, সড়কে বেআইনিভাবে ট্রাক্টর চলাচল করছে। আমরা যতটুকু সম্ভব অভিযান পরিচালনা করে ট্রাক্টর মালিক ও চালকদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেয়ার চেষ্টা করছি। মাসোহারা আদায়ের ব্যাপারে তিনি বলেন, এ ব্যাপারে আমি কিছু জানি না। কেউ কখনো অভিযোগ করেনি। তবে কারো বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে। রংপুর জেলা প্রশাসক এনামুল হাবিব বলেন, সড়ক-মহাসড়কে চলাচলকারী অবৈধ ট্রলি-ট্রাক্টরের বিরুদ্ধে শিগগিরই ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করবে জেলা প্রশাসন।